প্রশ্ন : উদাহরণসহ প্রকল্প পদ্ধতির বিবরণ দাও ।
উত্তর : যে পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো জীবনকেন্দ্রিক সমস্যাকে শিক্ষার্থীরা বাস্তব বা সামাজিক পরিবেশে আন্তরিকতার সঙ্গে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাধান করবে এবং এর ফলে শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবে তাকেই বলে প্রোজেক্ট বা কার্য – সমস্যা পদ্ধতি ।
প্রোজেক্ট বা প্রকল্প পদ্ধতির বিভিন্ন স্তর : প্রোজেক্টের উদ্দেশ্য হল বাস্তব সমস্যাসমাধানের মাধ্যমে শিক্ষালাভ । সমস্যা শিক্ষার্থীর সামনে উপস্থাপন করা হয় না । শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সমস্যা ঠিক করে । সমস্যাসমাধানের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীরা একটি পরিকল্পনা রচনা করে । এই পরিকল্পনার চারটি স্তর আছে । সেই স্তরগুলি হচ্ছে—
1. উদ্দেশ্যস্থাপন : এই স্তরে শিক্ষার্থীরা স্থির করবে কেন তারা সমস্যাটি গ্রহণ করেছে । এবং এর দ্বারা বাস্তবে কী উদ্দেশ্য সাধিত হবে । সমস্যাটি শিক্ষার্থীরা নিজে ঠিক করতে পারে বা শিক্ষকের সাহায্যেও স্থির করতে পারে । প্রোজেক্টের সমস্যাসমাধানের কাজে শিক্ষক উপদেষ্টার ভূমিকা নেবেন । প্রোজেক্টটি এমন নির্বাচন করতে হবে ( আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ) যাতে সব শিক্ষার্থীরা ওই প্রোজেক্টটিতে অংশগ্রহণ করতে পারে ও প্রোজেক্টের উদ্দেশ্য তাদের কাছে পরিষ্কার হয় ।
2. পরিকল্পনা : উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা গঠন করার পর কীভাবে বা কী উপায়ে সমস্যাসমাধান করা যায় সে সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে । সাধারণত পরিকল্পনাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয় । পরে ঠিক করা হয় কোন্ দল , কোন্ অংশটি সম্পন্ন করবে এবং দলের অন্তর্ভুক্ত শিক্ষার্থীরা কে , কী এবং কতটা কাজ করবে ।
3. কর্মসম্পাদন : এই স্তরে পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজটিকে সম্পন্ন করা হয় । এখানে শিক্ষকের কাজ হবে ছাত্রদের কাজ দেখাশোনা করা , পরামর্শ ও উৎসাহ দেওয়া , প্রয়োজনে সহযোগিতা করা । কাজের শেষে শিক্ষার্থীরা কাজের বিবরণ , ফলাফল লিপিবন্ধ করবে ।
4. বিচারকরণ : সমস্যাটি পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন হবার পর এর মূল্যায়ন করা হয় । বিচার করা হয় সমস্যার সঠিক সমাধান হয়েছে কিনা , যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সমস্যাটি গ্রহণ করা হয়েছিল , সমাধানে কোথায় ত্রুটি হয়েছে , কেন ত্রুটি হল প্রভৃতি । শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা কম বলে সবসময় তারা সঠিক কাজ করে উঠতে পারে না , ফলে অনেক ভুল হতেই পারে , সেই ভুলগুলি শিক্ষক সহানুভূতির সঙ্গে সংশোধনের উপায় বলে দেবেন ।
প্রোজেক্ট পদ্ধতির সুবিধা
1. এই পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক মনস্তত্ত্বসম্মত ও গণতন্ত্রসম্মত । এক্ষেত্রে ছাত্ররা পরিকল্পনা করে , নিজেরাই কাজ করবে , পরস্পরের সঙ্গে আলাপ – আলোচনাও করে ।
2. এখানে শিক্ষার্থী নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী শেখার সুযোগ পায় ।
3. শিক্ষার্থী এখানে কর্মের মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে বলে প্রতিটি কাজের যে বিশেষ মর্যাদা আছে তা সে বুঝতে শেখে ।
4. কর্মের মাধ্যমে শিক্ষালাভ হওয়ায় ভুলে যাবার সম্ভাবনা কম ।
5. সহযোগিতার মনোভাব , আত্মপ্রত্যয় , স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতা প্রভৃতি মানসিক বৃত্তিগুলির বিকাশ ঘটে ।
6. এক্ষেত্রে জোর করে শৃঙ্খলা চাপিয়ে দেওয়া হয় না । কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থী নিজেই শৃঙ্খলার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ।
7. প্রোজেক্ট পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক চেতনা ও যৌথচেতনা গড়ে ওঠে ।
৪. ব্যক্তিগত পার্থক্যভেদে শিক্ষার সুযোগ আছে । মেধাবী ছাত্র যেমন তার মেধা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ পায় সাধারণ শিক্ষার্থীও তেমনি তার বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতে পারে ।
9. প্রোজেক্ট একটি অনুবন্ধ পদ্ধতি । একই সময়ে একাধিক বিষয়ে শিক্ষালাভ করার সুযোগ এখানে আছে । বিজ্ঞান বিষয়ক একটি প্রোজেক্ট সফল করে তুলতে গেলে । ইতিহাস , ভূগোল , অঙ্ক , সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন হয় ।
10. বাস্তব প্রয়োজন মেটানোর মধ্যেই যে শিক্ষালাভ করা যায় এবং শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য যে বাস্তব সমস্যাসমাধান এ ধারণা শিক্ষার্থীর জন্মে ।
11. শিক্ষার্থীর মৌলচিন্তার ( original thinking ) বিকাশ ঘটে ।
12. জ্ঞান অর্জন এবং তার বাস্তব প্রয়োগ ছাড়াও এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীর সামাজিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশে সাহায্য করে ।
13. পুথিগত বিদ্যার দৌরাত্ম্য থেকে প্রোজেক্ট শিক্ষার্থীকে মুক্তি দেয় ।
14. নিজ হাতে শিক্ষার্থীদের কাজ করতে হয় , ছবি আঁকতে হয় , রিপোর্ট লিখতে হয় ফলে শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক দক্ষতা বাড়ে ।
15. শিক্ষার্থীরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করে , বই পড়ে , প্রোজেক্টের কাজের জন্য তাদের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় , মডেল তৈরি করতে হয় ইত্যাদি । সুতরাং এইসব কাজের মাধ্যমে তাদের মধ্যে ভৌতবিজ্ঞানে আগ্রহ ও সৃজনধর্মী কাজে উৎসাহ বাড়ে । তারা জীবনকেন্দ্রিক বিভিন্ন সমস্যাসমাধানে আগ্রহী হয় ।
• 16. শিক্ষার্থী যখন প্রোজেক্টে অংশগ্রহণ করে তখন তাকে সেই প্রোজেক্ট সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক কিছু জানতে হয় । এই জানার জন্য সে বই পড়ে , শিক্ষক মহাশয়দের সঙ্গে যিনি এই বিষয় বোঝেন তার সঙ্গে ও বন্ধুবান্ধবদের সাথেও আলোচনা করে , ফলে ওই বিষয়টি সম্বন্ধে তার জ্ঞান , বোধ , প্রয়োগ ও দক্ষতা সম্পর্কীয় বিজ্ঞান শিক্ষায় ক । উদ্দেশ্যগুলি যথাযথ বিকাশ ঘটে ।
• 17. ওই বিষয়ক বৈজ্ঞানিক সূত্র , তথ্য সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করতে পারে ।
• 18. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে ।
প্রোজেক্ট পদ্ধতির অসুবিধা :
1. এই পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল । তাই আমাদের মতো গরিব দেশে এই পদ্ধতির প্রয়োগ অসুবিধাজনক ।
2. সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রোজেক্ট পরিচালনা সম্ভব । অধিক শিক্ষার্থীদের ( যা আমাদের বিদ্যালয়গুলির বৈশিষ্ট্য ) নিয়ে সার্থকভাবে প্রোজেক্টের রূপ দেওয়া সম্ভব নয় ।
3. প্রায় প্রতিটি প্রোজেক্টই সম্পন্ন হতে সময় লাগে । ফলে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্দিষ্ট সময়ে পাঠ্যসূচি শেষ করা যায় না । আবার কিছু কিছু পাঠ্যাংশ আছে যাকে প্রোজেক্টে রূপ দেওয়া সম্ভব নয় । প্রোজেক্ট পদ্ধতির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করলে ওই অংশগুলি জানার সুযোগ হয় না । প্রোজেক্টের মাধ্যমে শিক্ষার ধারাবাহিকতা যা জ্ঞানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য তা ঠিক বুঝে উঠতে পারা যায় না ।
4. প্রোজেক্ট পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী সব রকমের শিক্ষার সুযোগ পায় না । প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ ধরনের কাজ থাকে , যেমন — কেউ করে হিসাব রক্ষার কাজ , কেউ প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে , আবার কেউ উৎপাদিত বস্তু বিক্রি করে । প্রতিটি শিক্ষার্থীকে নিজের কাজের প্রতি লক্ষ রাখতে হয় । কাজেই প্রোজেক্ট থেকে সে সম্পূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না । এরই মধ্যে যারা বুদ্ধিমান এবং উদ্যোগী তারা অধিকাংশ কাজই সম্পন্ন করে আর যারা অন্তর্মুখী তারা অনেক ক্ষেত্রে কাজ করে না বা কাজ করার সুযোগ পায় না ।
5. অধিকাংশ প্রোজেক্টেই হাতেকলমে কাজের অংশই বেশি থাকে । তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের দিকটা অবহেলিত হয় ।
6. প্রোজেক্ট পদ্ধতিকে সার্থক রূপ দিতে হলে শিক্ষককে যথেষ্ট সক্রিয় এবং সচেতন হতে হবে । প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রতি তাঁর নজর দিতে হবে । শিক্ষার্থীদের ঠিক পথে পরিচালিত অর্থাৎ শিক্ষককে অত্যধিক পরিশ্রম করতে হয় । করতে হবে , তাদের অসুবিধায় সাহায্য করতে হবে , তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ।
7. প্রোজেক্ট পদ্ধতি অনুসৃত পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা খুবই কম ।
8. বিদ্যালয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতির অসুবিধা দেখা যায় । যে বিদ্যালয়ে এই পদ্ধতি প্রচলিত নেই সেই বিদ্যালয় থেকে অন্য বিদ্যালয়ে ( যেখানে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় ) গেলে শিক্ষার্থীকে খুবই অসুবিধায় পড়তে হয় ।
9. অনভিজ্ঞতার জন্য তরুণ শিক্ষার্থীরা স্বাধীন মতামত দিতে অনেকক্ষেত্রে অক্ষম হয় ।
প্রোজেক্ট পদ্ধতির উদাহরণ :
পাঠ – শহরের জল সরবরাহ ( শ্রেণি — সপ্তম ) ।
এই পদ্ধতিতে শহরের জল সরবরাহ ব্যবস্থা পড়ালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে আচরণগত পরিবর্তন ঘটবে সেগুলি হল ওই বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান , বোধ , প্রয়োগ ও দক্ষতা । এই বিষয়টিকে পাঠদান করতে হলে শিক্ষণের যে ধাপগুলি অনুসরণ করতে হবে সেগুলি হল—
( a ) উদ্দেশ্য স্থাপন : জলের অপর নাম জীবন । কিন্তু এই জল যদি বিশুদ্ধ না হয় । তাহলে বিভিন্ন ব্যাধির সৃষ্টি হতে পারে । যার ফলে অকালে মৃত্যুবরণ করাও পানীয় জল সংগ্রহ করে অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় । গ্রামের লোকেরা কীভাবে পানীয় জল সংগ্ৰহ করে ? সেখানে জলের উৎস কী ? কীভাবে গ্রামের লোকেরা জল বিশুদ্ধ করে ? যেখানে নলকূপ , পুকুর , ডোবা ইত্যাদি কম সেখানে কীভাবে জল সরবরাহ করা হয় ? শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক উক্ত তথ্যগুলি আলোচনার পর শিক্ষার্থীদের নিয়ে জল সরবরাহ কেন্দ্রটি পরিদর্শনে যাবেন ।
( b ) পরিকল্পনা : জল সরবরাহ কেন্দ্র পরিদর্শনের উদ্দেশ্য এবং সেখানে কী কী তথ্যসংগ্রহ করতে হবে শিক্ষক সে সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন । সাধারণত নিম্নলিখিত তথ্যগুলি সংগ্রহ করার জন্য শিক্ষক প্রস্তাব দেবেন । ( ক ) জল সরবরাহের উৎস এবং কেন একে উৎস করা হয়েছে । ( খ ) উৎসস্থলে কী ধরনের অবিশুদ্ধতা থাকতে পারে । ( গ ) কীভাবে দূষিত জল বিশুদ্ধ করা হয় তার বিশদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা । ( ঘ ) বিশুদ্ধ জলকে কীভাবে সংরক্ষিত করা হয় । সংরক্ষিত স্থানকে উঁচু করা হয় কেন । ( ঙ ) কীভাবে রাস্তা এবং শহরের বাড়িতে জল সরবরাহ হয় । ( চ ) ব্যবহৃত জল কোথায় যায় । ( ছ ) সরবরাহে কী ধরনের অসুবিধা দেখা যেতে পারে । তার জন্যে কোনো সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে কিনা ইত্যাদি ।
( c ) কর্মসম্পাদনা : উপরোক্ত তথ্যগুলি শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সংগ্রহ করবে । কোনো দল জলের উৎসের কাছে যাবে , কোনো দল জল সরবরাহের অফিসে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে । আবার কোনো দল বিশেষজ্ঞের নিকট থেকে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সংগ্রহ করবে । জল সরবরাহ সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা একটি মডেল প্রস্তুত করে তার বিভিন্ন অংশগুলির চিত্র অঙ্কন করবে । সংগৃহীত তথ্যগুলি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে যাতে সকলের স্পষ্ট ও নির্ভুল ধারণা গড়ে ওঠে । এ ব্যাপারে শিক্ষক প্রয়োজনীয় সাহায্য করবেন ।
( d ) আলোচনা ও মূল্যায়ন : প্রতিটি শিক্ষার্থী জল সরবরাহ সম্পর্কে মন্তব্যসহ রচনা লিখবে । শিক্ষকের উপস্থিতিতে শ্রেণিকক্ষে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে ও তাদের কাজের মূল্যায়ন করবে ।
শিক্ষক বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন রচনা , প্রশ্নোত্তর , সাক্ষাৎকার প্রভৃতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন । ত্রুটি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশ দেবেন । কাজের ভিত্তিতে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করলে যেমন — জলের সাম্যাবস্থা , সাইফন , জলের গভীরতা ও চাপের সম্পর্ক , জল বিশোধন , খরজল ও মৃদুজল , জলপাম্পের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি ।