প্রশ্ন : 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন সম্পর্কে লিখুন ।
উত্তর : মিশনারিদের শিক্ষা বিস্তার ও ধর্মপ্রচারের ব্যাপারে যে সন্দেহ বাদানুবাদ ও বিরোধিতা ভারত ও ইংল্যান্ডে আলোড়ন তুলেছিল প্রধানত তারই ফলস্বরূপ 1813 খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনটি পরিবর্তিত হল । এই সনদে ভারতীয়দের ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় ।
1813 খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনের উপর ছিল ভারতের তদানীন্তন রাজনৈতিক ও শিক্ষগত অবস্থার প্রভাব । এই সনদ আইন অনুযায়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নতুন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে আসে । প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা মাদ্রাসা , এশিয়াটিক সোসাইটির বারাণসী সংস্কৃত কলেজ , ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ইত্যাদি । এই প্রতিষ্ঠানগুলি স্থাপনের পেছনে সরকারি উদ্যোগ থাকলেও শিক্ষা দেবার কোনো নির্দিষ্ট নীতি ছিল না ।
এই সময় ইংরেজদের ফরাসি ভীতি দূর হয়েছিল । ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে পারে এমন কোনো শক্তি তখন আর রইল না । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল । দেশের সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করার সময় এসেছে বিবেচনা করল ব্রিটিশ প্রভুরা । এই প্রেক্ষাপটে 1813 খ্রিস্টাব্দে সনদ নবীকরণের সময় এল ।
সনদের বিষয়বস্তু আলোচনা করার সময় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মতামত গৃহীত হল । প্রাচ্যবাদীরা ভারতের পাশ্চাত্য সভ্যতা তথা খ্রিস্টান চিন্তাধারা বিস্তারের পক্ষপাতী ছিলেন না । লর্ড মিন্টোর প্রস্তাব ছিল ভারতের নিজস্ব প্রাচীন কৃষ্টি কে উৎসাহিত করা । তিনি বলেছিলেন যে , ভারতের ধর্ম নৈতিকতা , শিক্ষার মান , শিক্ষিতের সংখ্যা সবই অবক্ষয়ের পথে । এর পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি উদ্যোগ ও অর্থব্যয় আবশ্যক । তিনি এই সঙ্গে মিশনারির প্রচেষ্টাকেও উৎসাহিত করার কথা বলেছিলেন । মিন্টোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে 1813 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মিশনারি ও শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাবনা পেশ হয় । তারই ফলশ্রুতি হল 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন ।
প্রভাব : 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন ভারতের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেছিল । এই আইনে বলা হয় যে
প্রথমত , এই সনদের অস্পষ্ট তার জন্য পাশ্চাত্য তথা ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা সহজসাধ্য হল । তাই 1835 খ্রিস্টাব্দে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও তার মাধ্যমে ইংরেজি ভাষা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করল ।
দ্বিতীয়ত , সনদের মধ্যে নিহিত ছিল ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার বীজ , যা স্বাধীন ভারতে জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য হিসাবে স্বীকৃত । যদিও এই ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতিটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের শাসন ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার জন্যই গ্রহণ করেছিল । তবে এই নীতির ফলে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা নিঃসন্দেহে উপকৃতই হয়েছিল ।
তৃতীয়ত , শিক্ষাক্ষেত্রে মিশনারিদের উদ্যোগকে উৎসাহদান পরোক্ষভাবে বেসরকারি উদ্যোগকেই অনুপ্রাণিত করেছে । তাই আজও আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ পাশাপাশি চলছে ।
1813 খ্রিস্টাব্দে সনদ আইন একটি আপস রক্ষা আইন । কিন্তু এই সাময়িক আপসের মধ্যে লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যৎ শিক্ষা দ্বন্দ্বের বীজ । যা থেকে উঠে এসেছিল আধুনিক শিক্ষার কাঠামোটি । অপরদিকে এই আইন ইংরেজি শিক্ষার পথকে প্রশস্ত করেছিল । তাই বলা যায় , “The Charter Act of 1813 forms a milestone in the history of modern education in India .” অর্থাৎ আধুনিক ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন একটি ভবিষ্যৎ পথনির্দেশ ।