সুকুমার রায়

✳️ সুকুমার রায় ✳️


🔵 সুকুমার রায় (৩০ অক্টোবর ১৮৮৭ – ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩) ছিলেন একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে “ননসেন্স ছড়া”র প্রবর্তক। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সন্তান এবং তার পুত্র খ্যাতিমান ভারতীয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তার লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হ-য-ব-র-ল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু, এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা “ননসেন্স” ধরনের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ধ্রুপদী সাহিত্যই যাদের সমকক্ষ। মৃত্যুর বহু বছর পরেও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।

🔵 সুকুমার রায় এর রচনা :

সুকুমারের রচনা কাব্যগ্রন্থ আবােল তাবােল, খাইখাই, প্রবন্ধ – অতীতের ছবি, বর্ণমালাতত্ত্ব, নাটক — অবাক জলপান, ঝালাপালা, লক্ষণের শক্তিশেল, হিংসুটে, ভাবুকসভা, চলসি রুরি ও শব্দকল্পদ্রুম, গল্পগ্রন্থ হ – য – ব – র – ল, পাগলা দাশু, বহুরূপী প্রভৃতি। তাছাড়া ইংরাজি ও বাংলায় তিনি কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন। সুকুমার ছিলেন রসিক মনের মানুষ। ফলে তার স্বভাবসুলভ রসের সঙ্গে প্রখর কল্পনা ও অপরূপভাষা মিলে তাঁর রচনাগুলিকে করে তুলেছিল পরম উপভােগ্য। লেখাকে অধিকতর স্বাদু করে তুলেছিল তার আঁকা ছবি। ১৯২১ খ্রিঃ জন্ম হয় সুকুমারের একমাত্র সন্তান সত্যজিতের।

🔵 রচনাবলি :

✅ আবোল তাবোল
✅ পাগলা দাশু
✅ হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি
✅ খাই-খাই
✅ অবাক জলপান
✅ লক্ষ্মণের শক্তিশেল
✅ ঝালাপালা ও অনান্য নাটক
✅ হ য ব র ল
✅ শব্দ কল্প দ্রুম
✅ চলচ্চিত্তচঞ্চরী
✅ বহুরুপী
✅ ভাষার অত্যাচার

🔵 কর্ম জীবন :
সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তার প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন তার লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তার বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তার অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তার প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার।


“সাগর যেথা লুটিয়ে পড়ে নতুন মেঘের দেশে
আকাশ-ধোয়া নীল যেখানে সাগর জলে মেশে।
মেঘের শিশু ঘুমায় সেথা আকাশ-দোলায় শুয়ে-
ভোরের রবি জাগায় তারে সোনার কাঠি ছুঁয়ে।”
—সুকুমার রায় রচিত ছড়ার অংশবিশেষ।

প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তার আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মানডে ক্লাব (ইংরেজি ভাষা: Monday Club) নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। মনডে ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করতেন। সুকুমার রায় মজার ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মুখ্যত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষণা ইত্যাদি।

ইংলান্ডে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখনও নোবেল পুরস্কার পাননি। ইতিমধ্যে সুকুমার লেখচিত্রী/প্রচ্ছদশিল্পীরূপেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। তার প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মেলে, নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলো থেকে।

সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্য ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠির এক তরুণ নেতা। ব্রাহ্ম সমাজ, রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী, অদ্বৈতে বিশ্বাসী হিন্দুধর্মের এক শাখা যারা ৭ম শতকের অদ্বৈতবাদী হিন্দু পুরান ঈশ-উপনিষদ মতাদর্শে বিশ্বাসী। সুকুমার রায় ‘অতীতের কথা’ নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসকে সরল ভাষায় ব্যক্ত করে – ছোটদের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের মতাদর্শের উপস্থপনা করার লক্ষে এই কাব্যটি একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ওই সময়ের সবথেকে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম ছিলেন, তার ব্রাহ্মসমাজের সভাপতিত্বের প্রস্তাবের পৃষ্ঠপোষকতা সুকুমার করেছিলেন।


🔵 সুকুমার রায় এর জন্ম স্থান ও পিতামাতা :

বাংলা শিশু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক সুকুমার রায়ের জন্ম হয় ১৮৮৭ খ্রিঃ ৩০ শে অক্টোবর কলকাতায়। তার পিতা উপেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরী ছিলেন শিশু সাহিতিক, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী ও যন্ত্রকুশলী।

🔵 সুকুমার রায় এর ছোটবেলা :

পিতার কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে সাহিত্যের প্রতিভা লাভ করেছিলেন সুকুমার। অল্প বয়স থেকেই মুখে মুখে ছড়া তৈরি করতে পারতেন। ছবি আঁকারও হাতেখড়ি হয়েছিল বাবা উপেন্দ্র কিশােরের কাছে। আঁকার সঙ্গে ফটোগ্রাফির চর্চাও শুরু করেছিলেন ছেলেবেলা থেকেই।

🔵 সুকুমার রায় এর শিক্ষাজীবন :

পড়াশুনা শুরু করেন সিটি স্কুলে। রসায়নে অনার্স সহ বি.এস.সি পাশ করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। এরপর ফটোগ্রাফি আর মুদ্রণ শিল্পে উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য গুরুপ্রসন্ন ঘােষ স্কলারশিপ নিয়ে ১৯১১ খ্রিঃ বিলেত যান।
স্কুলে পাঠরত অবস্থাতেই ছােটদের হাসির নাটক লেখা ও অভিনয়ের শুরু। বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তােলেন ননসেন্স ক্লাব। ক্লাবের মুখপত্রের নাম ছিল সাড়ে বত্রিশ – ভাজা। বিলেত যাবার আগে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে গােড়ায় গলদ নাটকে অভিনয় করেন।

🔵 সুকুমার রায় এর প্রথম জীবন :
লন্ডনের পেনরােজ পত্রিকার সঙ্গে উপেন্দ্রকিশােরের যােগাযােগ ছিল। বিলাত বাসের সময় এই পত্রিকার সম্পাদক মিঃ গম্বেল – এর সহযােগিতা পেয়েছিলেন। তারই চিঠি নিয়ে সুকুমার লন্ডনের L.C.C.School of Photo Engraving and Lithography তে বিশেষ ছাত্ররূপে ভর্তি হন।

এই সময় ফটোগ্রাফিক সােসাইটি লাইব্রেরিতে নিয়মিত পড়াশােনাও করতেন। ১৯১২ খ্রিঃ ম্যাঞ্চেস্টারের স্কুল অব টেকনােলজিতে বিশেষ ছাত্ররূপে স্টুডিও ও লেবরেটরির কাজ শিখেছিলেন।

পড়াশােনার কাজের ফাঁকে সুকুমার প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন। এই সুযােগে লন্ডন প্রবাসী অনেক বিখ্যাত বাঙ্গালীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি নিয়ে লন্ডনে গেলে সুকুমার তাকে নানাভাবে সহযােগিতা করেছিলেন।

এইসময় East and West Society- এর আহ্বানে সুকুমার (Sukumar Ray) নিজের লেখা প্রবন্ধ The Spirit of Rabindranath পাঠ করেন। এই প্রবন্ধের সঙ্গে কবির অনেকগুলি কবিতার অনুবাদ ছিল। পরে প্রবন্ধটি Quest পত্রিকায় ছাপা হয়।

লন্ডনে দুবছর ছিলেন সুকুমার। সেখান থেকে নিয়মিত ভাবে গল্প, কবিতা ও আঁকা ছবি পাঠাতেন বাবার সন্দেশ পত্রিকার জন্য। এই ভাবেই তিনি সন্দেশের পাঠক – পাঠিকাদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

লন্ডনে থাকা কালে সুকুমার রয়েল ফটোগ্রাফিক সােসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। তার আগে একমাত্র স্যার যতীন্দ্রমােহন ঠাকুর এই সম্মান পেয়েছিলেন। সুকুমার (Sukumar Ray) দেশে ফিরে এসে পিতার প্রতিষ্ঠিত ইউ রায় অ্যান্ড সন্স – এর দায়িত্ব নিলেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য উপেন্দ্রকিশাের আগেই প্রতিষ্ঠানের ভার তুলে দিয়েছিলেন ছেলেদের হাতে।

🔵 সুকুমার রায় এর কর্ম জীবন :

ইতিমধ্যে সুকুমারের বিয়ে হল। রবীন্দ্রনাথ বন্ধুপুত্রের বিয়েতে শিলাইদহ থেকে এসেছিলেন কলকাতায়। ১৯৯০ খ্রিঃ উপেন্দ্রকিশােরের মৃত্যু হয়। সুকুমার ভাইদের সঙ্গে ব্যবসায় পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হলেন। এই সময় তার উদ্যোগে গড়ে ওঠে মানডে ক্লাব। এই ক্লাবের সভ্যদের মধ্যে ছিলেন কালিদাস নাগ, অতুলপ্রসাদ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

সন্দেশের প্রতিটি সংখ্যাতেই সুকুমার (Sukumar Ray) নানা বিষয়ে লিখতেন, ছবি আঁকতেন। শিশু – কিশােরদের উপযােগী বিজ্ঞান – সাহিত্য রচনায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন। সুকুমারের গল্প ও কবিতায় থাকতাে উচ্ছল কৌতুক রসের সঙ্গে সূক্ষ্ম সমাজ চেতনার সংমিশ্রণ। তিনি তার লেখা ও ছবির মাধ্যমে বাংলা দেশের শিশুচিত্ত জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সন্দেশে লেখার গােড়ার দিকে সুকুমার ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। উহ্য নাম পণ্ডিত ছিল তার ছদ্মনাম। পরে স্বনামেই লেখেন গল্প, কবিতা, নাটক ও প্রবন্ধ। জীবনের শেষ পর্বে অবশ্য কিছু লেখা লিখেছিলেন উহ্যনাম পণ্ডিত নামে।


🔵 সুকুমার রায় এর মৃত্যু :

এরপরেই তিনি আক্রান্ত হন কালাজ্বরে। দুই বছরেরও বেশি সময় সংগ্রাম করেছেন রােগের সঙ্গে। অসুস্থ অবস্থাতেও অনর্গল লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ এসে তাকে গান শােনাতেন, ধর্মকথা শােনাতেন পণ্ডিত ক্ষিতিমােহন সেন। জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছিল। ১৯২৩ খ্রিঃ ১০ ই সেপ্টেম্বর সুকুমার রায় পরলােক গমন করেন।

Related posts:

তোত্তে- চানের আডভেঞ্চার - তেৎসুকো কুরোয়ানাগি
লিঙ্গ : পুংলিঙ্গ , স্ত্রীলিঙ্গ এবং ক্লীবলিঙ্গ ।
ভাষা শিক্ষণের নৈপুণ্যতা
আদর্শ বলা / আদর্শ কথন
স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির সঠিক উচ্চারণ
যুক্তবর্ণের উচ্চারণ : উষ্ট্র , রাষ্ট্র , ট্রেন , চিত্ত , বিত্ত , মত্ত , যুক্ত , রক্ত , শক্ত, যত্ন , ...
যুক্তবর্ণের উচ্চারণ : দ্বন্দ্ব , বিদ্বান , বিদ্বেষ , বদ্ধ , উদ্ধার
অনুলিখন vs শ্রুতিলিখন
কীভাবে শ্রুতিলিখন শ্রেণিকক্ষে শেখানাে যায় ?
বলা , পড়া ও লেখার ক্ষেত্রে যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার রীতি
বাংলা ব্যাকরণের কিছু প্রশ্নোত্তর
বলা , পড়া ও লেখার ক্ষেত্রে যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার রীতি
কীভাবে শ্রুতিলিখন শ্রেণিকক্ষে শেখানাে যায় ?
অনুলিখন vs শ্রুতিলিখন
কীভাবে হাতের লেখা শেখানাে হবে
ভালাে হস্তাক্ষরের বৈশিষ্ট্য
হাতের লেখা অনুশীলনের উদ্দেশ্য
স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির সঠিক উচ্চারণ
ভালাে কথাবার্তা শেখানাের কৌশল
আদর্শ বলা / আদর্শ কথন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page