শিক্ষার রাজনৈতিক প্রকৃতি সম্পর্কে লিখুন ।
উত্তর :- সাধারণভাবে বিচার করলে তাত্ত্বিক দিক থেকে শিক্ষার উপর রাজনীতির কোনো সম্পর্ক না থাকলেও ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে শিক্ষার উপর দেশের রাজনীতির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব সর্বকালে সব দেশেই দেখা গেছে । একেই শিক্ষার রাজনৈতিক প্রকৃতি বলা হয় । দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে । আমাদের দেশ অর্থাৎ ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই বক্তব্যের যথার্থতা বিচার করা যায় ।
প্রাচীন ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থায় রাজা মহারাজাগণ প্রত্যক্ষ বা সরাসরি শিক্ষার উপর হস্তক্ষেপ না করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য জমিদান এবং পরিচালনার জন্য আর্থিক সাহায্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁদের যথেষ্ট সহযোগিতা ছিল । অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই দান বা সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো শর্ত আরোপ করা না হলেও শাসকের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি ছিল । তবে সাহায্যের শর্ত হিসাবে কখনোই শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতিতে বাধা দেওয়া হয়নি ।
মধ্যযুগের ( যা প্রধানত ‘ ইসলামি যুগ ’ বলে পরিচিত ) শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ ইসলামি শিক্ষার ’ প্রাধান্য দেখা যায় । এই সময়ের সুলতানি শাসকগণ কেবলমাত্র ইসলামি শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন । ইসলামি বা মুসলিম শিক্ষা প্রবলভাবেই রাজশক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল । স্বাভাবিকভাবেই এই শিক্ষাব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক প্রভাব দেখা যায় । এই রাজনৈতিক প্রভাব গোষ্ঠীগত বা আদর্শগত নয় সম্পূর্ণভাবেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক । যুগ চরিত্র অনুযায়ী সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী সুলতান ও বাদশাহগণ ছিলেন স্বৈরাচারী । প্রশাসনের সব ক্ষেত্রের মতো শিক্ষার ক্ষেত্রেও শেষ কথা ছিল রাজা বা বাদশাহ । তারা যদি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক হতেন । তবেই শিক্ষার বিস্তার ঘটত এবং শিক্ষার উন্নতি হত অন্যথায় দেখা দিত শিক্ষার দুর্দশা । এককথায় বলা যায় শিক্ষার উপর একনায়কতন্ত্র রাজনীতির প্রকৃতি হল স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ।
আধুনিক যুগের প্রথম দিকে ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার শিকার হয় । ( ইউরোপীয় রাজশক্তি ) ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার নগ্নরূপের সঙ্গে আমরা ভারতবাসী পরিচিত হই , শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও ঔপনিবেশিক চরিত্র প্রবলভাবে দেখা যায় । তবে এটি মধ্যযুগের মতো ব্যক্তিভিত্তিক স্বৈরাচারী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না , ছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠীর দীর্ঘ সময়ব্যাপী শাসনব্যবস্থা কায়েম করার জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন তা প্রচলন করা । তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা স্থায়ী করা যাবে । তাই এক দিকে যেমন দেশজ শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করা , অন্যদিকে তেমনি ‘ চুঁইয়ে পড়া শিক্ষা নীতি ’ এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি ভাষার প্রবর্তন । এখানেও তাই শিক্ষার উপর রাজনৈতিক প্রভাব দেখা যায় । তবে এই রাজনৈতিক প্রভাব ব্যক্তিভিত্তিক নয় সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক প্রভাব ।