একটি নদী যখন মরা নদী হয়, তখন সেই নদী জেগে ওঠে মাঝরাতে। একটি বাড়ি যখন পোড়া বাড়ি হয়, তখন সেই বাড়িটি জেগে ওঠে মাঝরাতে। অতৃপ্ত কোন কিছুর জেগে ওঠার সময় হলো মধ্যরাত। সময়টা ছিলো শীতের শুরুর দিকে। আমাদের বন্ধুমহলে সবাই ঘুরতে পছন্দ করে। এমনি এক সময় আমাদের এক বন্ধু রনিদের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার দাওয়াত পড়ে। অথ্যাৎ আমি সহ আরো ২ বন্ধু মিলে বন্ধু রনিদের বাড়িতে বেড়াতে যাই। রনি আমাদের স্টেশনে আনতে যায়। আসার পথেই চায়ের দোকানে বসে এক পাক আড্ডা দিচ্ছিলাম। ওই আড্ডায় রনি বলে, আমাদের সাথে নাকি তার একটা কথা শেয়ার করার আছে। সে বলে, প্রায় রাতে তার কোন একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু সে এটা বুঝতে পারে না যে কিসের শব্দে তার ঘুম ভাঙে। প্রায় সময় সে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পায়। তার নাম ধরে কেউ একজনের ডাকার শব্দ শুনতে পায়। দরজায় তার নাম ধরে টোকা দেওয়ার আওয়াজ শুনতে পায়, কিন্তু দরজা খুলে কাউকে পায় না। সে প্রায় রাতে একটা স্বপ্ন দেখে, গভির রাতে সে তাদের বাড়ির উঠানে দাড়িয়ে থাকে, চারদিকে ভয়ংঙ্কর আওয়াজ শুনতে পায়, চারদিকে বাচার আত্মচিৎকার শুনতে পায়, খুবই করুন গলায় সাহায্যের চিৎকার শুনতে পায়, কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। যখন তার ঘুম ভাঙে তখন তার চোখে পানি আর মনে ভয় দুটোই থাকে। এই স্বপ্নের কোন উৎসই সে আজ পর্যন্ত পায় নি। . আমরা সব বন্ধুরা একটু অবাকই হই।
কেন না আমাদের বন্ধুর সাথে এমন জিনিস ঘটে, অথচ আমরা কিছুই জানতাম না। আড্ডা শেষে সবাই বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সাধারনত শীতকালে খুব দ্রুত সন্ধ্যা নামে। আমরা একত্রেই হাটছিলাম। সবারই রনির ঘটনা শুনে মনে ভয় ঢুকে যায়। পথমধ্যেই মাগরিবের আযান শুনতে পাই। ভয়ে ভয়ে সবাই কোন মতে রনিদের বাসা পর্যন্ত যাই। আন্টি আমাদের দেখে খুব খুশি হন। রনিরা ছিলো বংশগত ভাবেই সম্পদশালী। আর রনিই ছিলো তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাদের ঘরে নিয়ে আন্টি নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। আন্টির কাছে জানতে পারলাম আর দুইদিন পর রনির ২১তম জন্মদিন। তখনই বন্ধুরা সবাই মিলে পরিকল্পনা করলাম বড় করে একটা অনুষ্ঠান করবো। বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে ১১ টা বেজে যায় বুঝতেই পারি নি। সবাই খাওয়া দাওয়া করে রুমে চলে আসলাম। চিন্তা করলাম আজ সারা রাত গল্প করে কাটাবো। কেউ ঘুমাবো না। . যেই ভাবা সেই কাজ। কিছুক্ষন গল্প করার পর রনি বললো ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। বালিশের সাথে মাথা লাগানোর সাথে রনি ঘুমিয়ে যায়। আমরা বাকিরা আড্ডা দিতে থাকি। আমাদের আড্ডার মাঝখানে এক বন্ধু খেয়াল করলো রনির চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। ৩ জনই খুব ভয় পেয়ে গেলাম।
বুঝতে পারলাম রনি আমাদের যেই স্বপ্নের কথা বলছিলো এখন ওই স্বপ্নই দেখতেছে। এক বন্ধু দ্রুত রনিকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে ফেলে। রনির ঘুম ভাঙার পর ও খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। হঠ্যাৎই কারেন্ট চলে যায়। রুমের মধ্যে প্রচন্ড গরম বাতাস বইতে শুরু করে। চারদিক শুধু অন্ধকার ছিলো। এক বন্ধু মোবাইলে বাতি দিলো। আমরা ৩ জনই ঠিক আছি, কিন্তু রনি রুমে নেই। পুরো রুম ভালো করে খুজলাম, কিন্তু কোথাও পেলাম না। তখনই ওর সেই স্বপ্নের কথা আমার মনে পড়ে গেলো। ঘর থেকে একটা চার্জার লাইট নিয়ে ৩ জনই উঠানে বেরিয়ে পড়ি। কেননা ও বলেছিলো স্বপ্নে ও ওদের উঠানের মাঝখানে দাড়িয়ে থাকে, চারদিকে নানান ধরনের আওয়াজ শুনতে পায়। তাই দেরি না করে দ্রুতই উঠানে বেরিয়ে পড়ি। সময় তখন রাত ৩ টার কাছাকাছি। পুরো উঠান ভালো করে খুজে দেখলাম, কোথাও রনিকে পেলাম না। হঠ্যাং এক বন্ধু দেখতে পেলো উঠানের মাঝখানে বেলগাছ টার মাঝামাঝি জায়গায় রনি হাওয়ায় ভাসছে। এই দৃশ্য দেখে ৩ জনই খুব ভয় পেয়ে যাই। হঠ্যাৎ করেই ধপাস করে মাটিতে আছড়ে পড়লো। পড়ার শব্দ শুনে ভয়ে ৩ জনই ভিতরের দিকে দৌড় দেই। খেয়াল করে দেখি ওটা রনি। ওকে ধরাধরি করে রুমে নিয়ে যাই। আমাদের আওয়াজ শুনে আন্টির ঘুম ভেঙে যায়। উনি দৌড়ে রুমে এসে রনির এই অবস্থা দেখে কাঁদতে শুরু করেন। কোন রকমে আন্টিকে শান্ত করে রাতটা পার করলাম। . সকালে রনির জ্ঞান ফেরে।
ওকে সব জিজ্ঞেস করার পর ও সেই স্বপ্নের কথাই বলে। বলে ও ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সেই স্বপ্নটা দেখে, এবং স্বাভাবিক ভাবেই নাকি সকালে ওর ঘুম ভাঙে। বুঝতে পারলাম গত রাতের ব্যাপারে ও কিছুই জানে না। তাই ওকে আর কিছুই বললাম না। এই ব্যাপারে আন্টি আমাদের জিজ্ঞেস করলে ওনাকে সব খুলে বলি। এরপর আন্টি মুখে কাপড় গুজে কাঁদতে শুরু করেন। আন্টি বলেন, ওনিও এরকম প্রায় দিন ফজরের ওযু করতে বাহিরে গিয়ে দেখে রনি উঠানে পড়ে আছে। রনিকে জিজ্ঞেস করলে সেই স্বপ্নের কথাই আন্টিকে বলে। অথ্যাৎ রাতের ব্যাপারে ও কিচ্ছু জানে না। তাই আন্টিও আগ বাড়িয়ে রাতের ব্যাপারটা ওকে বলে না। বুঝতে পারলাম না রনির সাথে এসব কি হচ্ছে। আন্টি নিজেও এখনো এর ব্যাখ্যা খুজে পান নি। রনির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আমাদের কারো কাছেই সুবিধার মনে হয়নি। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এর একটা বিহিত করবো। সময় নষ্ট না করে ওকে সাথে নিয়ে এক পরিচিত কবিরাজের কাছে যাই। রনিকে নিয়ে কবিরাজের সামনে বসা মাত্র ওনার চোখ মুখ কেমন যেনো অন্ধকার হয়ে যায়। রনির সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই উনি বলে দেন। রনিও এই প্রথম জানলো ওর সাথে রাতে কি কি ঘটে। কবিরাজ আমাদের বলেন, –তোমরা খুব দ্রুত এখান থেকে চলে যাও।(কবিরাজ) –আমরা আপনার কাছে এর সমাধান খুজতে এসেছি। আমাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না প্লিজ। –কোন সমাধানে কোন লাভ হবে না। ওর সামনে খুব বিপদ। –একটা উপায় তো বলুন।
–একটা উপায় আছে। কিন্তু তোমাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সবাই মিলে অনেক অনুরোধ করার পর উনি একটা সমাধানের পথ দেখিয়ে দেন। উনি একটা কাগজে কিছু লিখে সেটা রনির হাতে দেন। . রনিকে একটা কঠিন পরিক্ষা দিতে বলেন। –আজ ঠিক মধ্যরাতে তুমি সেই পূর্বের স্বপ্নটা দেখবে। কিন্তু আজ তুমি কোন মতেই ভয় পেতে পারবে না। যে তোমায় এই স্বপ্ন দেখায় সে একটি প্রসিদ্ধ খারাপ জ্বীণ, সে আড়ালে লুকিয়ে থাকে। কোন মতেই তার হাত থেকে তুমি বাচতে পারবে না, যদি না তুমি তাকে আড়াল থেকে বের করে আনতে না পারো। –কিভাবে তাকে আড়াল থেকে বের করা যাবে?(রনি) –তুমি যখন স্বপ্ন দেখো, তখন সে তোমাকে নানান ধরনের শব্দ করে ভয় দেখায়। ওই স্বপ্নেই তোমাকে তার সাথে মোকাবেলা করতে হবে। সে যখন আড়াল থেকে তোমাকে ভয় দেখাবে, তখন তোমাকেও কথা বলতে হবে। তবে তা সাধারন কথা নয়। তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু উসকানি মুলক কথা বলতে হবে। যাতে করে সে রেগে গিয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। তবে হ্যা, ও আড়াল থেকে বের হয়েই তোমার সামনে আসবে, এবং তোমাকে হত্যা করতে চাইবে। তোমার আসল পরিক্ষাটা হবে এই জায়গায়, যখন সে আড়াল থেকে সরাসরি তোমার সামনে আসবে তখন তোমার ঘুম ভাঙতে হবে। অথ্যাৎ তোমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে। দেরি হলে তুমি আর কোন দিন ঘুৃম থেকে উঠতে পারবে না। ঘুমের মধ্যেই তুমি মারা যাবে। আর যদি তাড়াতাড়ি জাগানো হয়, তাহলে তার পরের দিনই মধ্যরাতে তোমার নিশ্চিত মৃত্যু হবে। –আমরা কিভাবে বুঝবো এটা? –এটাও একটা পরিক্ষা, তোমাদের বুঝে নিতে হবে এবং সময় মতো ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে। –যদি সব ঠিকঠাক মতো হয় তাহলে কি হবে?(আমি) –যদি সব ঠিকঠাক মতো হয় তাহলে আরো একটা পরিক্ষা দিতে হবে ওকে। তোমরা কেউ ওকে সাহায্য করতে পারবে না। –কি পরিক্ষা?
–ওকে ঘুম থেকে জাগানোর পর এই কাগজটা ওর হাতে দিবা। –তারপর? –তুমি এই কাগজ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বে। এবং এই এলাকার যেই চার রাস্তার মোড় আছে সেখানে যেতে হবে। মোড়ে দাড়িয়ে তুমি যেই রাস্তা দিয়ে গিয়েছো সেই রাস্তা ব্যতীত বাকি ৩ রাস্তার মধ্যে যেকোন একটা রাস্তা বেছে নিতে হবে। এই জন্য তুমি একবারই সুযোগ পাবে। . এরপর ওই রাস্তার দিকে দশ কদম হাটবে। যদি তোমার বেছে নেওয়া রাস্তা সঠিক হয় তাহলে দশ কদম শেষ হওয়ার আগেই সে চলে আসবে। –কে আসবে? –চারটা নেকড়ে একটা পালকির মতো গাড়ি টেনে এনে তোমার সামনে দাড়াবে। তারপর তোমাকে এই কাগজটা ওই গাড়ির ভিতরে ছুড়ে মারতে হবে। তবে গাড়িটি ভুলেও স্পর্শ করা যাবে না এবং কাগজটাও খুলে পড়তে পারবে না। তোমার কাজ শেষ করে সোজা বাড়ি চলে আসবে। যদি কিছু ভুল হয় তাহলে কিছুই করার নাই। আর যদি সব কাজ ভালোয় ভালোয় শেষ করতে পারো তাহলে ফজরের ঠিক একটু আগে তোমার দরজায় টোকা পড়বে। দরজা খুলে তুমি একটা মরা সাপ পাবে। ফজরের আাযানের পর পরই তোমাকে ওই সাপটা নিয়ে একটা গোরস্থানে কবর দিয়ে আসতে হবে। –তারপর?