শিশির আর অপু দুই জন একসাথেই এই বছর মেডিকেল থেকে পাশ করেছে । ওদের দুজনেরই ইচ্ছে প্রত্যন্ত কোন গ্রামের হাসপাতালে গিয়ে মানুষের সেবা করা । একদিন ওরা বেরিয়ে পড়লো । শহর থেকে অনেক দূরে এক গ্রামে এসে হাজির হল । খুবই নির্জন গ্রামটি । মানুষজনও খুব কম । গ্রামের অদূরেই একটা পরিত্যক্ত হাসপাতাল আছে । হাসপাতালটি দুই তলা । বহু বছর আগে এই হাসপাতালে রোগীদের সেবা হত,গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা হত । কোন এক অজানা কারণে হাসপাতালটি বন্ধ হয় যায় । সেই থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এটি । শিশির আর অপু এই হাসপাতালটাকে নতুন করে চালু করার চিন্তা করলো । বিকাল তখন ঘনিয়ে আসছে । হাসপাতালের নিচের তলায় একটা রুম পরিষ্কার করলো ওরা আজকের রাতটা কাটানোর জন্য । প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গ্রাম থেকে আনিয়ে নিল ওরা । বলা তো যায় না রাতে কখন কি লাগে । আর হাসপাতাল থেকে গ্রামের সবচেয়ে কাছের বাড়িটাতে যেতেও ১০ কি ১৫ মিনিট লাগবে । তাই আলো থাকতে থাকতেই গ্রাম থেকে জিনিসপাতি আনিয়ে নিল ওরা । সন্ধ্যা হল । অন্ধকার নামলো চারদিকে । হাসপাতালের আঙ্গিনায় বসে কথা বলছে শিশির আর অপু । তখনই চাদর গায়ে দেওয়া একটা লোক আসলো । ওদেরকে বলল,এখনও সময় আছে চলে যাও এখান থেকে । জায়গাটা ভালো না । শিশির বলল,আংকেল,আমরা ভয় পাই না । কোন সমস্যা নেই । আপনিও চাইলে আমাদের সাথে থাকতে পারেন । কথা শুনে লোকটা চলে গেল । যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলে গেল,কপালে দুঃখ আছে তোমাদের ।আবারও আড্ডা শুরু করলো ওরা ।
হাসপাতালের দুইতলার সবগুলো রুমতালাবন্ধ । অনেক পুরানো তালা । জং ধরে গেছে । বিল্ডিংটাও খুব পুরানো । চুন, সুড়কিখসে পড়ছে । চাদেঁর আলোয় আবছা আলো বিরাজ করছে চারদিকে । চাদেঁর আলোয় হাসপাতালের অবয়বটাকে মনে হচ্ছে যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন কোন দৈত্য; যে কোন সময় জেগে উঠবে । হাসপাতালের পিছনের গাছগুলো হালকা বাতাসে নড়ছে । পাতাগুলো যেন ফিসফিস করে বলতে চাইছে,তোমরা চলে যাও এখান থেকে । আড্ডা মারতে মারতে কখন যে ১১ টা বেজে গেছে টেরই পেল না ওরা । খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো। সবে মাত্র ঘুম ধরেছে ওদের চোখে এমন সময় উপর তলা থেকে চিৎকার চেচাঁমিচি আর মানুষের পায়ের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো । অবাক হল ওরা । উপরের তলার সবগুলো রুমই তো তালা মারা। তাহলে আওয়াজ আসছে কি করে ।হাতে লাইট নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো ওরা । গিয়ে দেখলো সবগুলো রুমই খোলা । ভিতরে মোমবাতি আর হ্যারিকেন দিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে । দুইজন নার্স একজন রোগীকে ধরে রেখেছে । কিন্তু ওদের দিকে তাকাচ্ছে না কেউ । রোগীটা চেচাঁচ্ছে আর বলছে,আমাকে বাচাঁও । ভয়ে হাত পা কাপঁতে লাগলো শিশির আর অপুর । অপু একটু এগিয়ে গিয়ে কাপাঁ কন্ঠে বলল,ওকে ধরে রেখেছেন কেন আপনারা ? ঘাড় ঘুড়িয়ে অপুর দিকে তাকালো নার্স আর রোগীটা । ওদের চেহারা দেখে মুহূর্তের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে গেল অপু । শিশির কোন রকমে টেনে অপুকে রুম থকে বের করলো । রুম থেকে বের হতেই সবকিছু আগের মত হয়ে গেল । এখন আর কেউ নেই । রুমগুলোও তালাবদ্ধ । পানির ছিটা দিতেই জ্ঞান ফিরলো অপুর ।কিন্তু ভয়ে হাত পা কাপঁছে দুইজনেরই । হঠাৎ নিচ থেকে বিকট এক চিৎকার শুনা গেল । ওরা দৌড়ে নিচে গেল । নিচে গিয়ে দেখলো মাটিতে উপুর হয়ে পড়ে আছে সন্ধ্যা বেলা চাদর গায়ে দিয়ে আসা সেই লোকটা । মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে ।
দুই. শিশির অপুকে বলল,তাড়াতাড়ি যা আমার ব্যাগ থেকে ব্যান্ডেজ নিয়ে আয় । অনেক রক্ত বের হচ্ছে । অপু গিয়ে ব্যাগে ব্যান্ডেজ খুজেঁ পেল না । শিশিরকে ডেকে বলল ,একটু এদিকে আয় তো ব্যান্ডেজ খুঁজে পাচ্ছি না । শিশির লোকটাকে ওইখানে রেখেই অপুর কাছে গেল । ব্যান্ডেজ নিয়ে ফিরে এসে দেখলো লোকটা নেই । তার চেয়েও অবাক করা বিষয় হল সেখানে কোন রক্ত বা রক্তের দাগও নেই । ভয়ে হাত পা যেন অবশ হয়ে গেল ওদের । তখনই আবারও চিৎকার চেচাঁমিচি ভেসে আসতে লাগলো দুইতলা থেকে । ওরা উপরের দিকে তাকিঁয়ে দেখলো আবারও আলো জ্বলছে দুইতলার রুমগুলোতে আর ভেসে আসছে সেই রোগীর আর্তনাদ,আমাকে বাচাঁও । আর সহ্য করতে পারলো না ওরা । এক দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল । রাস্তার উপর দাড়িঁয়ে হাফাঁতে লাগলো দুজনেই । হঠাৎ দেখলো একটা লোক ওদের দিকেই হেঁটে আসছে । রাত তখন প্রায় তিনটা । ওরা ভাবতে লাগলো এত রাতে এই লোকটা এখানে কি করে । লোকটা ওদের কাছাকাছি আসতেই রক্ত হিম হয়ে গেল দুজনেরই । এ যে সেই চাদর গায়ে দেওয়া লোকটা । আবারও দৌড় দিল ওরা । এবার সোজা ওদের রুমে । দরজা জানালা লাগিয়ে চুপচাপ বিছানার উপর শুয়ে রইলো ওরা । উপর থেকে চিৎকার চেচাঁমিচি আর মানুষের পায়ের আওয়াজ ক্রমাগত ভেসেই আসতে লাগলো । সময় যেন কাটছেই না । ওরা বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে কখন ভোর হবে । হঠাৎ কে যেন ওদের দরজা নক করলো । কিন্তু ওরা ওদের জায়গা থেকে নড়লো না । বেশকিছুক্ষণ পর দরজায় নক করা বন্ধ হয়ে গেল । চারদিক নীরব । উপর থেকে কোন আওয়াজও আসছে না । তখনই ঘটলো অঘটনটা । আগে শিশিরই দেখলো দরজার নিচ দিয়ে রক্ত ওদের রুমে ঢুকছে । আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো রক্তের প্রবেশ গতি । কিছুক্ষণবাদে রুমের পুরো মেঝ রক্তে ভরে গেল । চোখ বন্ধ করে আল্লাহ্ নাম জপতে লাগলো দুজনে । তখনই ওদের কানে ভেসে আসলো ফজরের আযানের সুমধুর আওয়াজ । চোখ খুলে মেঝেতে তাকিঁয়ে দেখলো একদম পরিষ্কার । রক্তের কোন ছিঁটেফোঁটা দাগও নেই । হাফঁ ছেড়ে বাচঁলো যেন ওরা । কিছুক্ষণ বাদে দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে আসলো ওরা । আলো ফুটতে শুরু করেছে চারদিকে । ভোরের পাখিরা কিচির মিচির করছে । আকাশের পূর্ব কোণে সূর্য টা উঁকি মারলো । হাসপাতালের উঠানে এসে দাড়াঁলো ওরা । পুরাতন এই দুতলা বিল্ডিংটাকে এখন খুব অসহায় মনে হচ্ছে । এখন দেখে কে বলবে এই অসহায় বিল্ডিংটাই রাতে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় । রাতের ঘটনাগুলোকে স্রেফ দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে ওদের কাছে । ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে নিল ওরা । নাশতা করতে করতে শিশির বলল,বুঝলি অপু আমার কাছে মনে হয় দুইতলায় কোন রহস্য লুকিয়ে আছে । চল দুইতলায় গিয়ে একটু ঘুরে আসি । অপু হ্যা সম্মতি দিল । নাশতা শেষ করে ওরা উপরে গেল । জং পরা তালাটাকে ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকলো ওরা । ভেতরটা অন্ধকার । টর্চের আলোতে পুরো রুমটাতে চোখ বুলালো ওরা । মাকরশার জালে পরিপূর্ণ রুমটা । পুরানো সিট,বোতল আর কিছু প্যাকেট পড়ে আছে । একটু সামনে এগোলো ওরা । একটা ডেস্ক আর চেয়ার পড়ে আছে । ডেস্কের উপর ছোট একটা কার্ড । ময়লার আস্তর জমে আছে ওটার উপর । অপু সেটা পরিষ্কার করলো । তাতে লিখা : ডা: মাহাবুব মুনতাসির । নিচে সাক্ষাতের সময় উল্লেখ করা আছে । কার্ড টা পকেটে ঢুকালো অপু । ডেস্কের ড্রয়ার খুলে শিশির একটা চিরকুট পেল । অনেকদিন আগের লিখা । অস্পষ্ট হয়ে গেছে লেখাগুলো । শিশির পড়তে লাগলো চিরকুটটা ।
শেষ পর্ব. জোরে জোরে চিরকুটটা পড়তে লাগলো শিশির । তাতে লিখা : আমি ডাঃ মাহাবুব মুনতাসির । এই রোগীটার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী । আমার ভূলের প্রায়শ্চিত্ত আমি নিজেই করবো । আমার মৃত্যুর জন্য কেউই দায়ী নয় । অপু বলল,সুইসাইড নোট নাকি ? শিশির বলল,হতে পারে । হঠাৎ বাহির থেকে খুট করে একটা আওয়াজ আসলো । দৌড়ে ওরা বাহিরে আসলো । একটা বুড়ো লোক ওদেরকে দেখে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইলো । কিন্তু পারলো না । ধরে ফেলল অপু । জিজ্ঞাসা করলো,আপনি কে ? এখানে কি করেন ? লোকটা কাচুঁমাচু হয়ে বলল,আমি এই গ্রামেই থাকি । এই হাসপাতালের কেয়ারটেকার ছিলাম । শিশির বলল,তাহলে তো এই হাসপাতাল সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন । লোকটা মাথা দুলিয়ে হ্যা সম্মতি দিল । উঠানের এক কোণে গিয়ে বসলো ওরা । লোকটা বলল,১০ কি ১২ বছর আগেই হাসপাতালটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । তার আগে হাসপাতালটা ভালোই চলতো । একদিন মাহাবুব স্যারের ভুল চিকিৎসায় একজন রোগী মারা যায় । তখন গ্রামবাসীরা ডাক্তারকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় । কিন্তু তার আগেই মাহাবুব ডাক্তার আত্মহত্যা করেন । গ্রামবাসীরা ডাক্তার সাহেবের লাশটাকে কবর দিতে দিল না । হাসপাতালেই রেখে দিল । তারপর থেকেই হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেল । আর কেউ আসে না হাসপাতালে । শুরু হল ভূতের উপদ্রব । সবশুনে শিশির বলল,মনে হয় ডা: মাহাবুব মুনতাসিরের লাশটাকে কবর দিয়ে দিলে ভুতের উপদ্রব বন্ধ হয়ে যাবে । লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলো,আপনি কি জানেন লাশটা কোথায় ? লোকটা বলল,আসেন আমার সাথে । দুইতলার একটা রুম থেকে পাওয়া গেল ডা: মাহাবুব মুনতাসিরের কঙ্কাল । একজন হুজুর ডেকে কঙ্কালটাকে কবর দেওয়া হল । তারপর শিশির লোকটাকে বলল ,আপনার কাছে কি ডাক্তারের কোন ছবি আছে ? লোকটা বলল,আমার কাছে নাই তবে স্যারের চেম্বার রুমে ওনার একটা ছবি আছে । লোকটা গিয়ে ছবিটা নিয়ে আসলো ।
ছবিটা দেখে ওদের চোখ তো কপালে । এই যে সেই লোকটা যে কালকে চাদর গায়ে দিয়ে এসে ওদেরকে সাবধান করেছিল । কয়েক মাস পরের কথা । হাসপাতালটাকে মেরামত করে নতুনভাবে সাজিয়ে শিশির আর অপু রোগীদের চিকিৎসা করা শুরু করেছে । এখন আর কোন ভুতের উপদ্রব নেই । হাসপাতাল ভালোই চলছিল । একদিন বিকালে একজন মুমূর্ষ রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসলো ।লোকটাকে জরুরী ভিত্তিতে একটা ইনজেকশন দেওয়ার দরকার । কিন্তু হাসপাতালে এই ইনজেকশনটা নেই। আর ইনজেকশনটা খুব দ্রুত দিতে না পারলে লোকটাকে বাচাঁনো যাবে না । দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল শিশিরের । হঠাৎ দেখলো ওর সামনেই পড়ে আছে ইনজেকশনটা । শিশির তো অবাক । কোথা থেকে এটা আসলো ? অপুকে ডাক দিল । অপুও অবাক হল ইনজেকশনটা দেখে । চারদিকে তাকাতে লাগলো ওরা । হঠাৎ দেখলো হাসপাতালের উঠানের এক কোণ দিয়ে প্রস্থান করছে চাদর গায়ে দেওয়া ডা : মাহাবুব মুনতাসির ।