আদ্যিকালের সব মূর্তি সংগ্রহের ব্যাপারে আমার বন্ধু প্রশান্ত হালদারের ভীষণ আগ্রহ ছিল । অগাধ টাকার মালিক প্রশান্ত । থাকতাে বিহারের জামসেদুপুরের কন্ট্রাকটারস এরিয়াতে । সাজানাে – গােছানাে বাড়ির একেবারে শেষ প্রান্তে একটা বড় হলঘর তৈরি করেছিল শুধুমাত্র দুষ্প্রাপ্য মূর্তিগুলাের রাখার জন্যে । মূর্তি সংগ্রহের জন্যে সে প্রচুর টাকা খরচ তাে করতোই প্রয়ােজন হলে যে কোনাে মূল্যে কিনতে দ্বিধা করতাে না । অবশ্যই মূর্তি যদি তার পছন্দ হতাে । এই মূর্তি কেনার জন্য সে ভারতবর্ষ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশেই যাওয়া – আসা করতাে । প্রশান্তর স্ত্রী রুমা আর তার দুই ছেলের এ ব্যাপারে আপত্তি ছিল কিন্তু প্রশান্ত চিরকালই জেদী তাই কারুর কথায় বা আপত্তিতে সে কান দিত না ।
নভেম্বরের শেষ মানেই বিহারে তখন বেশ ঠাণ্ডা । এই সময় আমাকে অফিসের কনফারেন্সে যােগ দিতে রাঁচিতে যেতে হয়েছিল । কলকাতায় ফেরার আগে ঠিক করলাম জামসেদপুরে প্রশান্তর কাছে একদিন থেকে কলকাতায় ফিরবাে । রাঁচি থেকে সােজা শেয়ার ট্যাক্সি করে সেদিন ঠিক সন্ধ্যেবেলায় জামসেদপুরের বিষ্ণুপুরে পৌছে নামী মাদ্রাজী হােটেল থেকে কিছু মিষ্টি ও নোনতা খাবার কিনে , পায়ে হেঁটে কন্ট্রাকটারস এরিয়াতে যখন পৌঁছলাম তখন অন্ধকারটা বেশ ঘন হয়ে এসেছে । প্রশান্তর বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দেখলাম , অত বড় বাড়িটা কেমন যেন অন্ধকারে ডুবে রয়েছে । শুধুমাত্র একতলার একটা ঘরের জানলা দিয়ে আলাে এসে পড়েছে সামনের বাগানে । কলিং বেলটা বাজাতেই বাড়ির পুরনাে কাজের লােক বিপিন দরজাটা খুলে আমায় দেখে কেমন যেন বিষগ্ন হয়ে গেল । জিজ্ঞেস করলাম , বাবু আর বউদি কোথায় , তাদের বলাে আমি এসেছি ।
দাদাবাবুরা বসার ঘরে আছেন , আপনি যান আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসছি । নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে গিয়ে বসার ঘরে ঢুকে দেখি , প্রশান্তর দুই ছেলের গায়েই অশৌচের বেশ । ওদের গাঁ ঘেঁষে বসে আছেন প্রশান্তির এক দাদা ও অন্যান্য কয়েকজন অচেনা লােক । প্রশান্ত আমার বহুদিনের বন্ধু তাই ওর দাদা আমায় চেনে আর দুই ছেলে বসন্ত ও হেমন্ত তাে আমাকে ওদের বাবার মতােই ভক্তিশ্রদ্ধা করে । আমাকে দেখেই দুই ভাই চিৎকার করে কেঁদে বলে উঠল , আংকল , মা – বাবা দুজনেই আর নেই ।
বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেলাম ।
প্রশান্তর দাদা বললেন , মনে হচ্ছে আপনি ভীষণ শক্ড । একটু বিশ্রাম করুন চা খান তারপর সব শুনবেন ।
দুপুরের খাওয়ার পর বসার ঘরে গিয়ে হাজির হলাম আমি । প্রশান্তর দাদা , বসন্ত , হেমন্ত , সেই সঙ্গে বিপিনও তখন সেখানে উপস্থিত । বড় ছেলে বসন্তই শুরু করল –
মাস তিনেক আগে বাবার কাছে মূর্তি কেনাবেচার এক পুরনাে দালাল এসে হাজির । তার নাম রহিম । এসেছিল ভুটানের এক জায়গায় প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য একটা মূর্তির ব্যাপারে । খুবই সস্তায় মূর্তিটি পাওয়া যাবে বলে , রহিমের সঙ্গেই বাবা চলে গেলেন ভুটানে । ঠিক ওই সময় স্কুলের ছুটি কাটাতে আমরা দুই ভাই পাটনার হােস্টেল থেকে জামসেদপুরে চলে এসেছি । প্রায় দিন কুড়ি পর বাবা ফিরে এলেন মূর্তিটা নিয়ে । বাবার মুখে শুনেছিলাম , মূর্তিটা কিনতে অনেকেই বাবাকে বারণ করেছিল কিন্তু বাবা ভেবেছিলেন হয়তাে তারা কেউ মূর্তিটা কিনবে বলে তাঁকে কিনতে বারণ করছে । মুর্তিটা হলঘরের ঠিক মাঝখানে একটা ছােট পাথরের টেবিলের ওপর বাবা রেখেছিলেন । মূর্তি বিষয়ে আমাদের দু ভাইয়ের কোনাে উৎসাহই ছিল না । এ ব্যাপারে কোনােদিনই মাথা ঘামাইনি । মা কিন্তু এসবের ঘাের বিরােধী ছিলেন এবং এই নিয়ে বাবা ও মায়ের মধ্যে মাঝে মাঝে তুমুল ঝগড়া হতাে । কিন্তু দু চার দিনের মধ্যেই আবার সব স্বাভাবিক । কিন্তু এই মুর্তিটা আসার পর থেকেই মা যেন রাগে উন্মাদ হয়ে গেলেন । কিছুতেই ওই মর্তিটি বাড়িতে রাখবেন না । বাবাও জেদ ধরলেন ওটা থাকবেই । ইতিমধ্যে আমাদের ছুটি শেষ হয়ে গেলে আমরা পাটনায় চলে আসি । তারপর যা ঘটেছিল , সেটা বিপিনদা ভালাে করে বলতে পারবে ।
বিপিন এতক্ষণ দরজার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল । এবারে সে মাটিতে বসে বেশ ভয়ে ভয়ে বলতে শুরু করল , দাদাবাবুরা চলে যাবার পর ওই মূর্তি নিয়ে বাবু আর মায়ের মধ্যে এমন তুমুল ঝগড়া হলাে যে , দুজনে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন । আমি কত বােঝলাম কিন্তু আমার মত একজন গরীব লােকের কথা কে – ই বা শােনে বলুন । এরই মধ্যে একদিন সকালে বাবু আমায় বললেন , তিনি দুদিনের জন্যে বিশেষ । কাজে ঘাটশিলায় যাবেন , আমি যেন সবকিছু সামলাই । মূর্তি রাখার ঘরের চাবিটা হাতে দিয়ে সাবধান করে দিলেন এই ঘরটা যেন খােলা না হয় । এরপর বাবু চলে গেলেন , বাড়িতে রইলাম শুধু আমি আর মা ।
সেদিনই দুপুরে মা আমায় বললেন , আমি তােমাকে একশাে টাকা দেবাে , এই হতচ্ছাড়া মূর্তিটাকে একটা ব্যাগে পুরে দুরে কোনাে পুকুরে বা নদীতে ফেলে দিয়ে এসাে , নইলে মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলাে ।
আমি পড়লাম মহা ফাঁপরে । বাবুর হুকুম ঘর খুলবে না , মায়ের হুকুম মূর্তিটাকে ফেলে দিয়ে আসতে হবে । খুব ভয়ে ভয়ে মাকে বললাম , বাবু ওই ঘর খুলতে বারণ করে গেছেন ।
মা একটুও রাগ করলেন না । খুব করুণ ভাবে বললেন , ওই মূর্তি আসার পর থেকে সংসারে যেন আগুন লেগেছে । ওটাকে ফেলে না দিলে ওই আগুনে সবাই জ্বলে – পুড়ে মরবে । আমার আর দাদাবাবুদের কথা মনে ভেবে কাজটা কি তুমি করবে না বিপিন ?
মূর্তিটা আসার পর থেকে যে অশান্তি শুরু হয়েছিল তাতে আমারও রাগ ধরে গিয়েছিল ওটার ওপর । তাই বললাম , ঠিক আছে মা , বাবু যদি আমায় মারধাের কনে তাড়িয়েও দেয় তবুও সংসারের মঙ্গলের জন্যে আপনার কথামতাে আমি আজই ওটাকে বিদায় করে দেবাে ।
হলঘরের দরজা খুললাম মা আর আমি । ঘরে ঢুকে আমি এগিয়ে গেলাম মূর্তিটার দিকে । ওটাকে তুলে ব্যাগে ভরবাে । মূর্তিটার ওপর দিকে কোনাে ঠাকুরের মুখ আর নিচের দিকটা ছােট ছােট পাথর বসানাে অনেকটা সাপের ল্যাজের মতাে দেখতে । আমি তাড়াতাড়ি ওটাকে দুহাত দিয়ে ধরে তােলবার চেষ্টা করে দেখলাম মূর্তিটাকে কিছুতেই নাড়াতে পারছি না । মাকে বললাম , মা কী হবে , আমি তাে মূর্তিটাকে তুলতেই পারছি না । ভীষণ ভারী বলে মনে হচ্ছে । শুনে মাও এসে আমার সঙ্গে হাত লাগালেন , কিন্তু দুজনে মিলে অনেক চেষ্টা করেও মূর্তিটাকে একচুলও নড়াতে পারলাম না ।
জিজ্ঞেস করলাম , মূর্তিটা কী খুব বড় আর ভারী ছিল ?
বিপিন উত্তর দিল , একেবারেই নয় বাবু । ছােট্ট পুতুলের মতাে সাইজ ।
ওইটুকু মূর্তিকে তুমি আর বউদি দুজনে মিলেও তুলতে পারলে না ?
না বাবু , কিছুতেই পারলাম না । আমরা দুজনেই দেখলাম মুর্তিটার দুটো চোখ দিয়ে আগুনের মতাে আলাে বেরােচ্ছে আর পেছনের ল্যাজটাও কেমন যেন নড়েচড়ে উঠছে ।
ল্যাজের মধ্যে থেকেও একটা আলাে বেরিয়ে আসছে ।
তারপর ?
আমার মাথায় খুন চেপে গেল । আমি একটা মােটা দড়ি আর ছােট শাবল নিয়ে এসে মূর্তিটাকে দড়ি দিয়ে কষে বেঁধে যেই শাবল দিয়ে চার দিয়ে তুলতে গেছি , বললে বিশ্বাস করবেন না বাবু , আমাকে কে যেন মাটি থেকে তুলে নিয়ে এমন ধাক্কা মারল যে আমি দূরে ছিটকে গিয়ে আছড়ে পড়লাম মাটিতে । তারপর কী দেখলাম জানেন , মূর্তিটা একটা বীভৎস আকার ধারণ করে আরও যেন বড় হয়ে গেল আর ল্যাজটাও বিরাট বড় হয়ে গিয়ে আমাদের দুজনকেই জড়িয়ে ধরবার জন্যে এগিয়ে আসতে লাগল । ভয়ে আমি মাটি থেকে উঠে পড়েই মায়ের হাত ধরে তাঁকে টানতে টানতে হলঘরের বাইরে এনে দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে দিলাম ।
বিপিন আবার বলতে শুরু করলে , ওই ঘটনার পর মা যেন কেমন বদলে গেলেন । বাবুর সঙ্গে একটাও কথা বলতেন না । মাঝে মাঝে আমার সঙ্গেই একটু – আধটু কথা বলতেন ।
এরই মধ্যে একদিন মা আমায় ডেকে বললেন বিপিন , তুমি খােকাবাবুদের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছ , তুমি ওদের একটু দেখাে ।
কিছুই বুঝলাম না । খােকাবাবুরা পাটনাতে থেকে লেখাপড়া করছে , তারা ভালােই আছে , তাদের আবার কী দেখবাে ।
এর কয়েকদিন পর , ঠিক সন্ধ্যের সময় এই ঘরে বাবুকে চা দিচ্ছি , বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি ও ঝড়াে হাওয়া চলছে । সেই সময় এখানে কয়েকদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছিল আর তারই মধ্যে থেকে থেকে আলােগুলাে খুব কমে যাচ্ছিল । বাবুকে চা দিয়ে ঘর থেকে বেরােবার মুখে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম । এই ঝড় বৃষ্টি আর অন্ধকারের মধ্যে কে আবার এলাে ভেবে দরজাটা খুলে দেখি , অদ্ভুত চেহারার একজন লােক দাঁড়িয়ে আছে । সেদিন আবার রাস্তার একটা আলােও জুলছিল না । বাড়ির আলাে খুব টিমটিম করে জ্বলছিল । আবছা অন্ধকারের মধ্যে লােকটাকে ভালাে ভাবে লক্ষ্য করতে পারিনি ।
লােকটা হিন্দিতে বাবুর নাম বলে বলল , সে ওনার সঙ্গে দেখা করতে চায় । বললাম , আপনি একটু দাঁড়ান আমি বাবুকে গিয়ে বলছি । কিন্তু বাবুকে সংবাদটা দিয়ে পেছন ফিরেই দেখি লােকটা সােজা চলে এসেছে ঘরের মধ্যে । বাবু তাে রেগে টং । বললেন , আপনি কী রকম লােক মশাই , না বলে একেবারে বাড়ির মধ্যে ঢুকে এলেন ? কী চাই বলুন , আমিই প্রশান্ত হালদার ।
লােকটা বলল , আমার নাম মগ্নু , ভুটান থেকে আসছি । তারপর ঘরের চারদিকটা ভালাে করে দেখে নিয়ে বলল , মূর্তিটা কোথায় রেখেছেন ।
কোন্ মূর্তি ?
ভুটান থেকে আপনি যেটা এনেছেন ।
আমি কোথায় মূর্তি রেখেছি সেটা কী আপনাকে বলতে হবে ?
বিপিনকে থামিয়ে আমি প্রশ্ন করি , বৌওদি তখন কোথায় ছিলেন ?
বিপিন বলল ওপরে । তারপর আগের কথার খেই ধরে বিপিন পুনরায় বলতে লাগল , লােকটা একটা চুপ করে থেকে বলল আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন । মূর্তিটা বাড়িতে রাখলে আপনার এবং পরিবারের সকলের বিপদ হবে । ওটা সাক্ষাৎ শয়তান । এক কাপালিকের ছিল ওটা । তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ করে এক জঙ্গলের মধ্যে কাপালিক ওই মূর্তিটাকে দেখতে পায় । বাড়িতে নিয়ে এসে নিজের অসীম ক্ষমতা প্রয়ােগ করে সে ওই মূর্তির মধ্যে এক প্রেতাত্মার প্রবেশ ঘটিয়ে ওটাকে জীবন্ত করে তােলে । তারপর নিজের প্রয়ােজনমতাে মূর্তিটাকে পরিচালনা করে । মনের জোরে মূর্তিটা যেখানে খুশি যাওয়া – আসা করতে পারে । মূর্তিটার নিচের দিকে যে ল্যাজটা আছে ওইটাই বিশেষ করে মানুষকে আকর্ষণ করে কারণ ল্যাজটা মাঝে মাঝে আলােয় ভরে ওঠে আবার নিভে যায় । ল্যাজটার গায়ে যে নানা রংয়ের পাথর আছে সেই থেকেই আলাে বেরােয় এবং সেই সময় ল্যাজটাও নড়তে শুরু করে বিশাল হয়ে যায় । ওই ল্যাজটাই হলাে মূর্তিটার শক্তি । আপনিও সময়মতাে সেটা দেখতে পাবেন ।
বাবু চিৎকার করে বললেন , বিপিন ব্যাটাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দে । ঠিক সেই সময় মা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন , বিপিন কী হয়েছে , এত চেঁচামেচি কেন ? আমি কিছু বলার আগেই লােকটা বেশ ধমকের সুরে বলে উঠল , কাপালিকের মন্ত্রপুত মূর্তিকে যে রাখবে সেই মরবে । বাবু এবার আরও রেগে গিয়ে বলেন , মূর্তি আমার কাছেই আছে কিন্তু তুমি কে যে তােমার কথায় মূর্তিটা ফেরৎ দিয়ে দেবাে !
‘ আমি কে ’ বলে আবার সেই ভয়ানক অট্টহাসিতে ঘর ভরিয়ে তুলে লােকটি বলল , আমিই সে কাপালিক আর ওই মূর্তি আমারই সৃষ্টি ।
মা এই লােকটার উপস্থিতির কথা জানতেন না বলে একটু হকচকিয়ে গিয়ে ধপ করে সামনের সােফার ওপরে বসে পড়লেন । আমিও ভয় পেয়ে যেন মাটির সঙ্গে আটকে গেলাম । চোখের সামনে দেখলাম লােকটার জায়গায় লাল কাপড়ে দাঁড়িয়ে এক কাপালিক । তার চোখ দুটো আগুনের মতাে জ্বলছে আর জানলা দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ছে এলােমেলাে ঝড়াে হাওয়া । সমস্ত ঘরটা বরফের মতাে ঠাণ্ডা । মনে হলাে কাপালিকের দেহটা যেন শূন্যে ভাসছে । বাইরে তুমুল বৃষ্টি আর ঘরের ভেতরে ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোতে আমরাও যেন পাথর হয়ে গেছি । তখনও সে বলছে , আমি কাপালিকের প্রেতাত্মা ।
আমাদের সামনেই কাপালিকের চেহারাটা ছােট হয়ে গিয়ে শূন্যে উঠে ঘর থেকে বেরিয়েই যেন মিশে গেল অন্ধকারে ।
মায়ের কোনাে সাড়াশব্দ নেই । বাবুও যেন পাথরের মতাে হয়ে গিয়ে বসে আছেন সোফার ওপরে । আমারও যেন সব শক্তি লােপ পেয়েছে । হ্যাঁ বাবু তারপর যা বলছিলাম — আমি তাে এগিয়ে গেলাম বাবুর কাছে । বাবু ততক্ষণে যেন সামলে উঠেছেন । মায়ের কাছে গিয়ে দেখি মায়ের জ্ঞান নেই । চোখে মুখে জল দিয়ে গ্যাং ফিরিয়ে বাবু আর আমি মাকে ধরে ওপরে ওনার বিছানায় শুইয়ে দিলাম । বাবু ডাক্তারবাবুকে ফোন করলেন । ডাক্তারবাবু এসে মাকে দেখেটেখে কয়েকটা ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলেন । ওষুধগুলাে খাবার কয়েকদিন পর মা বেশ সুস্থ হয়ে উঠলেন । এই ঘটনার পর থেকে বাবু যেন আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন , কথাবার্তাও কম বলতেন আর রােজ সকালে হলঘরের চাবি খুলে ওই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখতেন । বাবু আর মায়ের এই অবস্থা দেখে আমি পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়ে বড়বাবুকে টেলিগ্রাম পাঠালাম ।
বড়বাবু কে ?
প্রশান্তর দাদা বললেন , আমি ।
প্রশান্তর দাদা বলতে লাগলাে টেলিগ্রাম যখন পৌছায় আমি তখন কাশীতে । বাড়ি ফিরে এখানে আসবাে যখন ভাবছি তখন আবার টেলিগ্রাম পেলাম । তাতে জানলাম প্রশান্ত ও বউমা দুজনেই মারা গেছে । আমি সেইদিনই চলে আসি । তারপর বসন্ত আর হেমন্তকে পাটনা থেকে নিয়ে এসে মর্গ থেকে বডি বার করে দাহ করাই ।
প্ৰশান্তর দাদা থামতে বিপিন আবার বলতে শুরু করল , প্রথম টেলিগ্রামের পর বড়বাবু এলেন না দেখে বাবুরই আর এক বন্ধু সাচিতে থাকেন তাকে গিয়ে সমস্ত ঘটনা জানালাম । কিন্তু তিনি আমার কথার কোন গুরুত্বই দিলেন না । খােকাবাবুদের জানিয়ে কোনাে লাভ নেই ভেবে জানাইনি । তবে আশপাশের দু চারজন পরিচিত লােককে সব জানিয়েছিলাম কিন্তু বাবুর ওই মেজাজের জন্যে ওনারা কাছে আসতে কেউ সাহস করেনি ।
আমি রােজই বিকেলে খাটাল থেকে দুধ আনতে যাই । সেদিনও দুধ আনতে গেছি , কিন্তু দুধ দিতে দেরি করায় বাড়ি আসতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে । গেটটা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে
ভেতরে যাবার সময় শুনলাম মায়ের চিৎকার । ছুটে গেলাম হলঘরের দিকে । দেখলাম মায়ের হাতে সেই ছােট শাবল আর বাবুর হাতে মূর্তিটা রয়েছে । কিছু বােঝবার বা বলবার আগেই মায়ের হাতের শাবলটা আছড়ে পড়ল বাবুর হাতের ওপর আর মূর্তিটা ছিটকে পড়ল মাটিতে । বাবু চিৎকার করে ধাক্কা দিয়ে মাকে ফেলে দিলেন মাটিতে । পড়ে থাকা মূর্তিটাকে হাতে নিয়ে মা আছড়াতে লাগলেন মাটিতে । ঘরের মধ্যে একটা আলাের ঝলকানির সঙ্গে দেখলাম মূর্তির সেই ল্যাজ থেকে বেরিয়ে আসছে একটা চোখ – ধাঁধানাে আলাে , ল্যাজটা বড় হচ্ছে আর মূর্তিটাও মাটি থেকে সােজা হয়ে উঠে ক্রমশ বীভৎস হয়ে যাচ্ছে । ল্যাজটা লম্বা হতে হতে ধরে ফেলল মায়ের গলা । মা চিৎকার করে উঠলেন । বাবুও ঝাপিয়ে পড়লেন ল্যাজটাকে ধরার জন্যে । আমি মা আর বাবুকে বাঁচাবার জন্যে ছুটে গিয়ে বাড়ির পাশেই ক্লাবের ছেলেদের আর পাড়ার কিছু লােককে ডেকে নিয়ে এলাম । বাড়িতে ঢুকে আমরা সবাই দেখলাম সেই ল্যাজটা বাবু আর মায়ের গলা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরেছে । মা ও বাবু দুজনেই ছটফট করছেন । আমরা ল্যাজটাকে ওঁদের গলা থেকে ছাড়াতে যেতেই সেটা ছােট হয়ে আগের অবস্থায় ফিরে গেল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা কালাে ধোঁয়া বেরিয়ে গেল জানলা দিয়ে । মূর্তিটা আমাদের চোখের সামনেই ধোঁয়া হয়ে মিশে গেল অন্ধকারে ।