বােলপুর শহর । সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিল দীপক । ভবানী প্রেসের পিয়ন হারু এসে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল হাতে । মুখে বলল , “ চিঠি । বড়বাবু দিলেন ।”
বড়বাবু অর্থাৎ শ্রীকুঞ্জবিহারী মাইতি । ভবানী প্রেসের মালিক এবং বােলপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘ বঙ্গবার্তার ’ একজন রিপাের্টার । বয়স বছর পঁচিশ । গ্র্যাজুয়েশনের পর আপাতত বাবার ব্যবসায় অল্পসল্প সাহায্য করা ছাড়া বাদবাকি সময় সাংবাদিকতার নেশায় কাটায় ।
দীপক চিরকুটে চোখ বােলাল । কুঞ্জবিহারী লিখেছেন , জরুরী দরকার । চটপট এস । দীপকের আর আড্ডা মারা হলাে না । সে হারুকে বলল , “ বল্ যাচ্ছি এখুনি ।’
ভবানী প্রেসের কাজ চলছে খটাখট শব্দে । একতলায় লম্বা প্রেস ঘরের এক কোণে ছােট্ট পার্টিশন ঘেরা অফিস । ভিতরে বসেন কুঞ্জবিহারী । স্যুইং – ডােরের মাথায় লেখা সম্পাদক , বঙ্গবার্তা । দীপক অফিস ঘরে উঁকি দিতেই কুঞ্জবিহারী হাসিমুখে সাদর আহ্বান জানালেন , ‘এস দীপক । তােমার অপেক্ষাতেই রয়েছি । বস ।’
মাঝবয়সী গাঁট্টাগােট্টা শ্যামবর্ণ কুঞ্জবিহারী একটু খটখটে লােক । সহজে হাসেন না । তাঁর এমন খুশিখুশি ভাব দেখে দীপক আন্দাজ করল , নির্ঘাৎ কোনাে জব্বর খবরের ক্লু পেয়েছেন সম্পাদক । আর দীপককে হয়তাে ছুটতে হবে তাঁরই খোঁজে । সে কৌতূহলী হয়ে শােনে ।
গোঁফ নাচিয়ে , চোখ কুঁচকিয়ে , হাসিটা আরও চড়িয়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন কুঞ্জবাবু , ‘বুঝলে দীপক , একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটেছে ! কাল সন্ধ্যায় পলাশডাঙ্গা গ্রামের গােলােকপতি আর নরহরি এসেছিল আমার বাসায় । দুজনেই চেনা লােক । বােলপুরে কেনাকাটি করতে এলে মাঝে মাঝে আমার ওখানে ঢুঁ মারে । পলাশডাঙ্গা কোথায় জান ? ”
দীপক বলল , ‘ ইলামবাজারের কাছে নেমে , বাস রাস্তা থেকে অজয় নদীর দিকে মাইল দেড়েক । কয়েকবার গেছি ।’
‘ বেশ , বেশ । নরহরি কুণ্ডুকে তাে তুমি দেখেছ । সেই যে গত শুক্রবার দুপুরে প্রেসে এসেছিল একটা বিল বই ছাপাতে । তুমি তখন ছিলে এখানে । বেঁটে , গােলগাল , ফর্সা ।’
হুঁ। দীপক ভেবে নিয়ে বলল , ‘নীল শার্ট আর ধুতি পরেছিল । বছর ত্রিশেক বয়স । তাই না ?’
‘ কারেক্ট ’ , সায় দিলেন কুঞ্জবিহারী , ‘ আর গােলােকপতি লম্বা রােগা । নরহরির চেয়ে বয়সে একটু বড় । তারপর বুঝলে হে আমার বাড়িতে বসে চা খেতে খেতে উঠল ভূতের প্রসঙ্গ । ব্যস , দুজনে তক্ক লাগাল , ভূত আছে কি নেই ?
গােলােকপতি বলে , ভূত আছে । নরহরি বলে , ভূত নেই । ঘাের তর্ক । শেষে ধরল বাজি ।
‘ পলাশডাঙ্গার কাছে অজয়ের তীরে নাকি একটা মস্ত শ্মশান আছে । নরহরি বেট ফেলেছে , ওই শ্মশানে সে একা যাবে আগামী শনিবার । রাত বারােটা নাগাদ , মানে পরশুদিন রাতে । গােলােকপতির দেওয়া একটা রুমাল বেঁধে দিয়ে আসতে হবে চুলের কাছে একটা খুঁটোয় । যদি সে এই কাজটা ঠিকঠাক করে চলে আসতে পরে , গােলােকপতিকে দিতে হবে একশাে টাকা ! তাই দিয়ে ক্লাবে ফিস্টি লাগাবে নরহরি ।’
‘শনিবার কি অমাবস্যা ?’ জানতে চায় দীপক ।
‘ না । তবে কৃষ্ণপক্ষের শেষাশেষি । অমাবস্যাতেই চেয়েছিল গােলােক । কিন্তু ওই দিন ছাড়া সুবিধে নেই নরহরির । যা হােক , শনিবারই ঠিক হয়েছে আমায় সাক্ষী মেনে । ঝট্ করে একটা আইডিয়া খেলে গেল মাথায় । তাই আমিও উস্কে দিয়ে পাকা করে দিলুম বাজিটা । কেন জান ? ’ মিটিমিটি রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে কুঞ্জবিহারী ধীরে ধীরে বললেন , ‘ ব্যাপারটা কভার করলে দারুণ একটা স্টোরি হবে । ভুমি পলাশডাঙ্গায় চলে যাবে শনিবার। রাতে শ্মশানটার কাছাকাছি কোথাও থেকে ওয়াচ্ করবে লুকিয়ে ।’
‘আবার ভূত ? ’ ভুরু কুঁচকে বলল দীপক ।
‘ কেন সাবজেক্টটা খারাপ কী ? দারুণ ইন্টারেস্টিং ।’
‘না না , ঐ ভূত – ফুতে আমায় আর টানবেন না । অন্য কিছু দিন । দীপকের প্রবল আপত্তি । কারণ এর আগে বঙ্গবার্তার জন্য ভুতুড়ে ব্যাপারে অনুসন্ধানে গিয়ে তার অভিজ্ঞতা মােটেই সুখের হয়নি ।
‘দেখ দীপক , এই রকম ব্যাপারে তােমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে বলেই না তােমাকে পাঠাতে চাই ’ , মােলায়েম কণ্ঠে বােঝান কুঞ্জবাবু ’ , ‘ বুঝলে কিনা , এটা হচ্ছে স্পেশালাইজেশনের যুগ । কোনাে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হলে লােকে দর দেয় বেশি । রিপাের্টার জগতেও বিশেষজ্ঞদের খাতির । এক একজন এক একটা বিষয়ে পােক্ত । কেউ হচ্ছে ক্রাইম রিপাের্টার । অর্থাৎ তার প্রধান কাজ হলাে অপরাধ জগতের খবরাখবর রাখা । তাই সে কেবল থানা – পুলিশের কাছে ঘুরঘুর করে । কারও নাম পলিটিক্যাল রিপাের্টার হিসেবে । রাজনৈতিক দল আর নেতাদের গােপন কীর্তিকলাপ ফাস করতে ওস্তাদ । কেউ আবার খেলার জগতের নাড়ি নক্ষত্রের খোঁজ রাখে । স্পাের্টস রির্পোটার হিসেবে তার খ্যাতি । কেউ যাত্রা সিনেমা থিয়েটারের পােকা । ফলে ওই লাইনে লেখা তার খােলে বেশি । তুমি যদি সুপারন্যাচারাল মানে অলৌকিক , মানে ভূতুড়ে ব্যাপারে কিঞ্চিৎ স্পেশালাইজ কর মন্দ কী ? এ লাইনে ভাল রিপাের্টার খুব কম । তােমার খুব দর হবে দেখে নিও ।’
সম্পাদকের উপদেশে বিন্দুমাত্র উৎসাহ না দেখিয়ে নিরস কন্ঠে দীপক বলল , ‘হয়তাে কিছুই ঘটবে না । ড্যাং ভ্যাং করে শ্মশানে গিয়ে রুমাল বেঁধে চলে আসবে ! মাঝ থেকে আমার হয়রানি সার হবে ।’
‘হবে হবে । কিছু না কিছু ঠিক ঘটবে ’ , কুঞ্জবিহারী মােটেই ভরসা হারান না, ‘আর যদি তেমন কিছু নাও ঘটে , তােমার কল্পনা আর কলম তাে রয়েছে । লােমহর্ষক রাতের শ্মশানের বর্ণনা । ভীতচকিত নরহরির আগমন ও প্রস্থান । তােমার নিজের কিছু গা ছমছমে অভিজ্ঞতা — এইসব সত্যি বা বানানাে মিশিয়ে — রং চড়িয়ে খাসা একখানা লেখা দাঁড় করাতে পারবে না ? পারবে , পারবে , আমি জানি সে এলেম তােমার আছে । এমন একটা বাজি । ব্যাপারটাই তাে দারুণ । আর যদি সত্যি তেমন কিছু ঘটে যায় তাে মার দিয়া কেল্লা –
দীপক গােমড়া মুখে ঘাড় নাড়ল ।
এতেও কাজ হলাে না দেখে এবার ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়লেন কুঞ্জবিহারী । চেয়ারে খাড়া হয়ে বসে দীপকের পানে কটমট করে তাকিয়ে গর্জে উঠল । ‘কাওয়ার্ড । ভীতু । তুমি ভয় পাচ্ছ রাত্তিরে শ্মশানে যেতে । এটাই আসল কারণ । নেহাৎ আমার একটা জরুরী কাজ আছে , নইলে আমি নিজেই যেতাম তােমাকে সাধতাম না ।’
আঁতে ঘা লাগাতে দীপক মুহূর্তে তেতে উঠে তেজের সঙ্গে বলে উঠল , ‘ মােটেই না । আমার অত ভয় – ডর নেই । সাবজেক্টটা পছন্দ হচ্ছিল না , তাই । ঠিক আছে । আমি যাব ।’
‘ভেরি – ভেরি গুড দ্য স্পিরিট ।’ সম্পাদক নিশ্চিন্ত হলেন ।
অফিস কামরায় গলা খাঁকারি শােনা গেল । ভবানী প্রেসের বৃদ্ধ কম্পােজিটর দুলালবাবু একখানা প্রুফ হাতে করে ঘরে ঢুকলেন । প্রুফটা কুঞ্জবাবুর টেবিলে নামিয়ে রেখে মৃদু কণ্ঠে বললেন , “ আজ্ঞে কাজটা কি ঠিক হবে ? মানে এই রাতের বেলা শ্বশানে-মশানে যাওয়া ?’
বােঝা গেল দুলালবাবু দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কুঞ্জবিহারী ও দীপকের কথাবার্তা শুনেছেন ।
এত কষ্টে দীপককে রাজী করিয়ে ফের বুঝি বেঁচে যায় । রেগে ঝাঝিয়ে উঠলেন কুঞ্জবাবু , ‘আপনি থামুন তাে মশাই । দীপক আপনার মতন ভীতু নয় ।’
দুলালবাব কিন্তু থামেন না । একই সুরে বলে চলেন , “ এমনি গােয়ার্তুমি করা কিন্তু মােটেই উচিত না । যদি কোনাে ডেঞ্জারেস অ্যাকসিডেন্ট হয় ? আমি একটা কেস শুনেছি ।
একজন বাজি রেখে মানে জ্যান্ত ফেরেনি । মারা পড়েছিল শ্মশানে ।’
‘ফুঃ । ওরকম গপ্পো ঢের রটে’ , দুলালবাবুকে নস্যাৎ করে দেন কুঞ্জবিহারী , আর সত্যি যদি তেমন কিছু হয় ফাস্ট ক্লাস । যা একখানা স্টোরি হবে বঙ্গবার্তায় ! স্পেশাল সংখ্যা করে ডবল ছাপব কাগজ ! হু হু করে কাটবে । কি দীপক , তুমি ঘাবড়ে গেলে ? “
মনে মনে কিঞ্চিৎ দমে গেলেও সম্পাদক মশায়ের খোঁচার ভয়ে বাইরে নির্বিকার ভাব দেখিয়ে দীপক বলল , ‘নাঃ , ওসব ভয় আমার নেই । আর ভয় না পেলে শুনেছি ভূত – টুতে কিছু করতে পারে না ।’
‘ রাইট ।’ সম্পাদক উল্লসিত । দুলালবাবুকে বললেন , “ শুনলেন তাে । তাছাড়া দীপককে তাে আর শ্মশানের মধ্যিখানে থাকতে হবে না । একটু দূরে থেকে লক্ষ্য রাখলেই চলবে ।’
দুলালবাবু তথাপি নিরস্ত হলেন না । বললেন , ‘ কিন্তু যদি কোনাে দুঘর্টনা ঘটে যায় । যদি লােকটির কিছু’ – বাকিটুকু উচ্চারণ না করলেও ইঙ্গিতে স্পষ্ট বােঝালেন তিনি কী আশঙ্কা করছেন — “ তখন যে পুলিশ এসে টানাটানি করবে দীপকবাবুকে নিয়ে ।’
‘রিপাের্টারকে পুলিশ কিস্সু বলবে না ’ , অভয় দিলেন সম্পাদক , ‘আর থানার সঙ্গে আমার জানাশােনা আছে । তেমন হলে ম্যানেজ করে দেব । যান আর বাজে কথা বাড়াবেন না।’
দুলালবাবু অপ্রসন্ন মুখে বিদায় নিলেন ।
‘ পলাশডাঙ্গায় তােমার কী কোনাে চেনাটেনা আছে থাকবার মতাে ? ’ চটপট কাজের কথা পাড়লেন কুঞ্জবাবু । হুঁ , আছে একজন । দূর সম্পর্কের আত্মীয় ।’ জানায় দীপক ।
ব্যস , প্রবলেম সলভ্ড্। অবিশ্যি তা নইলে আমিই ওখানে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিতুম । তবে নিজের লােকের কাছে থাকতেই বেশি ভাল লাগবে । বাস ভাড়াটাড়া খরচাপাতি কত চাই অ্যাডভান্স ? ‘
‘ সে পরে হবে । আগে ঘুরে আসি ।’ জানাল দীপক । সে জানে , বঙ্গবার্তা চালিয়ে মােটেই লাভ হয় না কুঞ্জবিহারীর । বরং গ্যাটের পয়সাই খসে । বঙ্গবার্তার রিপাের্টাররা তাই যথাসম্ভব কম দাবি করে সম্পাদকের কাছে ।
শনিবার সকালে দীপক পলাশডাঙ্গায় তার মাসতুতাে ভাই শিবপদর বাড়ি হাজির হলাে । শিবপদ অবাক ! বেজায় খুশি হয়ে বলল , “ কি সৌভাগ্য , এ্যাদ্দিন বাদে ! তুমি তাে আসই না এখানে । শহরের লােক , গাঁয়ে আসতে মন চায় না বুঝি ?’
দীপক কঁচুমাচু ভাবে বলল , তা নয় ভাই , সময় পাই না । বাড়ির সব ভাল ? ”
‘ ভালই । এদিকে যে হঠাৎ । কিছু কাজ আছে নাকি ? ”
‘ আছে । তবে তেমন কিছু নয় । সে পরে হবে । ‘
‘ আজ থাকবে তাে ? ”
‘ দিনে তাে থাকছি । বলা যায় না , বাত্তিরেও থেকে যেতে পারি ’ , রহস্যময় হেসে জানাল দীপক ।
‘ বেশ , বেশ ।’ শিবপদ ভারি খুশি ।
মাসির বাড়ির সবার সঙ্গে গল্পগুজব করে , চা – টা খেয়ে শিবপদ ওরফে শিবুকে বলল দীপক , ‘ চল গ্রামে ঘুরে আসি । তােমাদের গ্রামটি চমৎকার ।’
দুজনে বেরুল ।
পথে দীপক শিবুকে জিজ্ঞেস করল , “ আচ্ছা তােমাদের গাঁয়ের কীর্তনিয়া চৈতন্য ঠাকুর সন্ধ্যেবেলা গান বাজনা করেন এখনাে ?’
‘ হ্যা , করেন বৈকি । অনেকে গিয়ে জোটে ।’
‘বাঃ , খাসা ।’ দীপক মনে মনে ভাবে । সন্ধ্যেবেলায় শিবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গােপনে শ্মশানে হাজির হবার জন্য যে কয়েকটা প্ল্যান ভেজে এসেছিল । প্রথমটাই দেখছি লেগে গেল । শিবুকে সে বলল , “ ওবেলা ঠাকুরমশায়ের কাছে যাব একবার । ঘুরতে ঘুরতে দীপক বলল , এই গাঁয়ে গােলকপতি মুখুজ্যে বলে থাকে কেউ ?’
‘ হুঁ, থাকে । তুমি তাকে চেন নাকি ? ”
‘নাঃ । বঙ্গবার্তার এডিটরের সঙ্গে ওর চেনা আছে । নামটা একবার শুনেছিলাম তাঁর কাছে । এই পলাশডাঙ্গায় বাস । গােলােকপতির বাড়ি কোন্ পাড়ায় ?’
‘ মুখুজ্যে পাড়ায় ।’
মুখুজ্যে পাড়ায় ঢুকে শিবপদ দেখাল , ‘ওই যে গােলােকদা বসে আছেন দাওয়ায় ।’ দীপক আড়চোখে দেখে নিল । হুঁ , কুঞ্জবাবুর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে । গােলােকপতিও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল তাদের । দীপক গােলােকপতির কাছে ঘেঁষল না ।
পথে কয়েকজন গাঁয়ের লােকের সঙ্গে দীপকের পরিচয় করিয়ে দিল শিবপদ ।
ঘণ্টাখানেক চক্কর দেওয়ার পর দীপক শিবুকে জিজ্ঞেস করল ,-
‘ অজয় নদীর ধারে যাবার পথ কোনটা ?
‘ এই পথ ধরে সােজা ’ — দেখাল শিবপদ ।
দীপক বলল , “ আমি খানিক একা নদীর ধারে বেড়িয়ে আসি । তােমায় আর টানব । বাড়িতে থেকো । ফিরে গিয়ে চা খাবই ।’
লেখাপড়া জানা শহুরে ছেলে দীপককে বেশ উঁচু নজরে দেখে শিবু । তার ওপর কাগজের রিপাের্টার । ওর হালচালই আলাদা । একা একা নদীর ধারে ঘুরতে চায় নিশ্চয় কবিত্ব করতে । কে জানে হয়তাে পদ – টদ্য লেখে ।
‘তাড়াতাড়ি ফিরাে কিন্তু ’ — বলে শিবু বিদায় নিল ।
গ্রামের সীমানা পেরিয়ে মেঠো পথে যাবার সময় দীপক একজন চাষীকে জিজ্ঞেস করল , ‘ এখানে নদীর ধারে একটা শ্মশান আছে ? ”
‘হুঁ । আছে । জবাব দেয় ।
‘ এই পথে নদীতে পৌছে বাঁয়ে না ডাইনে ?
উত্তর হলাে — ‘ডাইনে ।’
দীপক ফের এগুলাে ।
দুপুরে শিবপদর বাড়িতে আহারটি পরিপাটি হলাে । খাবার পর শিবুকে একান্তে পেয়ে দীপক জানাল , ‘ বুঝলে বিকেলে সন্ধ্যে নাগাদ আমি চৈতন্য ঠাকুরের আখড়ায় যাব । গান শুনব । আর ওনার একটা ইন্টারভিউ নেব , মানে সাক্ষাৎকার । ওনার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস – টিজ্ঞেস করব । ইচ্ছে আছে ওঁকে নিয়ে কাগজে লিখব কিছু । ভারী গুণী মানুষ ।’
‘ তা বটে ।’ সায় দেয় শিবপদ ।
দীপক বলল , ‘আমার হয়তাে ফিরতে রাত হবে । সন্ধ্যের আগে যা হােক কিছু খেয়ে ঠাকুরমশায়ের আখড়ায় চলে যাব । বৈঠকখানা ঘরে আমার বিছানা করে বাইরের দরজা ভেজিয়ে রেখাে । আর অন্দর থেকে ভেতরের দোরটা বন্ধ করে তােমরা শুয়ে পড়বে । আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই । বলা যায় না হয়তাে ঠাকুর মশায়ের বাড়িতেই একটা চাদর জড়িয়ে শুয়ে পড়ব । ওনার সঙ্গে আমার দিব্যি পরিচয় আছে । গত জয়দেব – কেঁদুলীর মেলায় প্রায় গােটা রাতই ওঁর আসরে বসে গান শুনেছিলাম ।’
‘দিনের বেলাতেই কাজটা সেরে রাখলে পারতে । মিছিমিছি রাতে কষ্ট পাবে ।’ শিবপদ ক্ষুব্ধ হয় । সন্ধ্যেবেলা দীপকের সঙ্গে গল্প করার ইচ্ছে ছিল তার ।
‘কষ্ট আবার কী ?’ দীপক হাসে , রিপাের্টারদের এর চেয়ে ঢের বেশি কষ্ট সইতে হয় । সন্ধ্যের আসরে না বসলে বাবাজীকে বেশ মুডে পাব না ।’
দীপক বিকেলে চৈতন্য ঠাকুরের আখড়ায় গেল ঠিকই , কিন্তু থাকল না বেশিক্ষণ । মিনিট পনেরাে কথা বলে গান শুরু হবার আগেই “ঘুরে আসছি ” , বলে উঠে পড়ল । তারপর গ্রামের ভিতর খানিক এদিক – সেদিক ঘুরে সুযােগ বুঝে বেরিয়ে পড়ল গাঁয়ের বাইরে । লােকের চোখ এড়িয়ে হাঁটা দিল শুশানের উদ্দেশ্যে ।
সকালেই শ্মশানে ও নদীর ধারে ঘুরে গিয়েছিল দীপক । কোথায় বসবে রাতে সে জায়গাটাও ঠিক করে গেছল । শ্মশানের একধারে একটা ছােট পাকা ঘর । ঠিক ঘর বলা যায় না , কারণ তার তিন দিকে দেয়াল এবং একদিক ফাঁকা । ছাত টালির । ভিতরে বসার জন্য কয়েকটা লম্বা লম্বা বেদী । খুব শীতে বা ঝড়জলের রাতে শ্মশানযাত্রীদের এটি আশ্রয়স্থল । শ্মশানে ডােম একজন আছে বটে , কিন্তু কুটিরটি খানিক দূরে ।
নদীর উঁচু পাড়ে অনেকখানি এলাকা জুড়ে শ্মশান । ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাড় । দুপাশে বিস্তৃত বালুচরের মধ্য দিয়ে বইছে স্রোতস্বিনী নদী । নদীর তীর ঘেঁষে ঘন গাছপালার সারি । প্রকাণ্ড শ্মশান । অজস্র হাড়গােড় , পােড়া কাঠ ও বাঁশের টুকরাে ছড়ানাে রয়েছে । আশেপাশের অনেক গ্রামের লােক শবদাহ করতে আসে এখানে । শ্মশানভূমির ভেতরে ও কাছাকাছি প্রচুর ঝােপঝাড় ও কয়েকটা বড় বড় প্রাচীন গাছ । দীপক যখন শ্মশানে পৌঁছল তখন সূর্য প্রায় অস্তগামী । দিনের আলাে নিভে আসছে । নদীর স্রোত থিরিথিরি কাঁপছে , সিঁদৱে রােদের ছটা । লম্বা লম্বা গাছের মাথায় লালচে আভা আর তাদের তলায় ঘনাচ্ছে অন্ধকার । আকাশপথে নীড়ে ফিরছে দলে দলে পাখি । চারপাশে দেখে নিল দীপক । কোনাে লােক নজরে এল না । তবে সে সাবধান হতে কাঁধের ঝােলা থেকে একটা দুরবীন বের করে নদীর পাড়ে পায়চারি করতে করতে মাঝে মাঝে দুরবীনে চোখ লাগিয়ে গাছে বা আকাশে পাখিদের তাক করে দেখতে থাকে । ভাবখানা যেন এই উদ্দেশ্যেই তার হেথায় আগমন ।
আধঘণ্টা বাদে দিনের আলাে আরও ম্লান হতে দীপক চলল শ্মশানযাত্রীদের কুটিরটির দিকে । নজরদারির জন্য রাতটা এখানে কাটানােই সব থেকে সুবিধে । ফাঁকা মাঠে নদীর ধারে বাতাস বেশ কনকনে । রাতে হিমও পড়বে । ভাগ্যিস চাদরটা এনেছিল । ওই ছাউনিটা থেকে প্রায় গােটা শ্মশান দেখা যায় । সকালে সে ছাউনিটার ভিতর ও চারধারে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল সাপখােপের উপদ্রব ঠেকাতে । সঙ্গে সে অ্যাসিড এনেছিল বােলপুর থেকে এই উদ্দেশ্যে । দীপকের কাঁধের ঝােলায় রয়েছে কিছু টুকিটাকি জিনিস । যেমন টর্চ , থার্মোফ্লাস্কে চা , পেতে বসার জন্যে পুরনাে খবরের কাগজ ইত্যাদি ।
গুটিগুটি হেঁটে ছাউনিটার কাছে প্রায় পৌছে গেছে দীপক হঠাৎ ‘কী মশায় , এখানে কী করছেন ?’ কিঞ্চিৎ কর্কশ ও নাকি সুরে উচ্চারিত কথাগুলি পিছন থেকে শুনে সে চমকে উঠল ।
এক অচেনা ভদ্রলোক । বয়সে দীপকের চেয়ে কিছু বড় হবেন । মাঝারি লম্বা । রােগাটে গড়ন । পরিষ্কার রং । শুকনাে মুখখানায় চোখে পড়ার মতন একটিই জিনিস বেজায় লম্বা নাকখানা । গায়ে শার্ট ও খাটো ধুতির ওপর নস্যিরঙা চাদর জড়ানাে । খালি পা । লােকটি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন ।
দীপক থতমত খেয়ে বলল , ‘ এই মানে বেড়াচ্ছিলুম ।’
আপনাকে তাে চিনলেম না ? নিবাস কোথা ? ভদ্রলােক প্রশ্ন করেন ।
আমার বাড়ি বােলপুর । পলাশডাঙ্গায় বেড়াতে এসেছি আত্মীয়ের বাড়ি । আত্মীয়ের নাম শিবপদ ঘােষ । দীপক মুখে হাসি টেনে সহজ হবার চেষ্টা করে ।
‘ ও ’ , ভদ্রলােক মাথা নাড়েন । বােঝা গেল তিনি শিবুকে চেনেন , কিন্তু রাত হয়ে গেছে । এবার ফিরে যান । এ জায়গা ভাল নয় ।
‘ ই যাচ্ছি । দীপক এদিক – সেদিক তাকায় । সে মহাবিপাকে পড়ে । লােকটির নড়বার লক্ষণ নেই । বােধহয় দীপকের গতিবিধি সম্বন্ধে কিছু সন্দেহ জেগেছে । শেষটায় কী তীরে এসে তরী ডুববে ? সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে ? সে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করে , “ আজ্ঞে আপনি ?”
উত্তর এল , ‘ আমি অভয়পদ মণ্ডল । এখানেই থাকি ।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে নেয় দীপক । এখন কী করা যায় ? ফিরে যাবার ভান দেখিয়ে গ্রামের দিকে গেলে যদি ইনি সঙ্গ ধরেন ? লােকটির হাত থেকে ছাড়ান পেতে পেতে অন্ধকার যদি বেশি ঘন হয়ে যায় তখন তার পক্ষে শ্মশানে ফেরা অসম্ভব । চট করে অন্য এক বদ্ধি খেলে গেল মাথায় । যদি একে সব খুলে বলি ? হয়তাে বিশ্বাস করবেন তার কথা । হয়তাে তার কাজে বাধা নাও দিতে পারেন এবং অন্তত আজ রাতে গােপন রাখবেন ব্যাপারটা । বড়জোর কিছু উপদেশ বা ধমকধামক হজম করতে হবে এমন হঠকারিতার জন্য । যুক্তি দিয়ে , অনুরােধ করে লােকটিকে তখন বশ করা যাবে । এ ছাড়া তাে উপায় দেখ না ! মতলবটা ঠাউরে নিয়ে সে একটু ইতস্তত করে বলল , বুঝলেন , আসলে আমার এখানে আসার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে । আমি একজন রিপাের্টার ’ – দীপক ধীরে ধীরে শােনায় গােলকপতি ও নরহরির বাজি ধরার কাহিনী । কেন তাকে পাঠানাে হয়েছে এখানে এবং কি তার প্ল্যান ।
সব শুনে অভয়পদর মুখ থমথমে হয় গেল । গম্ভীর ভাবে বললেন , “ ও , এই ব্যাপার ! নরহরি কী সত্যি আসবে ?
‘ তা জানি না ’ , বলল দীপক , আসুক না আনুক , যা ঘটবে তাই রিপাের্ট করা আমার ডিউটি । তবে আমাদের এডিটর বলেছিলেন যে নরহরি কুণ্ডু নাকি বেজায় একগুঁয়ে । তাই ওর আসার সম্ভাবনাই বেশি । অভয়পদর মুখ আরও গম্ভীর হয় । মনে মনে প্রমাদ গােনে দীপক । বােঝা যাচ্ছে এমন বাজি ভদ্রলােকের মােটেই পছন্দ হয়নি । এখন বাগড়া না দিয়ে বসেন ? নরহরির শ্মশানে আসা না বন্ধ হয়ে যায় ।
অভয়পদ খানিকক্ষশ নীরব , চিন্তাকুল । তারপর বললেন , “ বেশ , আমিও থাকব আপনার সঙ্গে , দেখি কি হয় ?
শুনে দীপক ‘ থ ’ । এমন প্রস্তাব তার কল্পনার বাইরে ছিল । সঙ্গে সঙ্গে তার মনের কোণে একটু স্বস্তিও জাগে একজন সঙ্গী জুটলে মন্দ কী ! তবু সে হয়তাে আমতা আমতা করে বলে , কিন্তু আপনার বাড়িতে যে ভাববে ?
আমার জন্যে তেমন ভাববার কেউ নেই । কিঞ্চিৎ উদাস নিস্পৃহ সুরে মন্তব্য করেন অভয়পদ । “ আজ রাতে এক জায়গায় বাইরে থাকব বলেই বেরিয়েছিলুম । না হয় এখানেই রাত কাটাই ।
‘ আপনার কষ্ট হবে ।
‘ কিসসু না । কষ্ট করা আমার অভ্যেস আছে । দীপকের কুষ্ঠিত আপত্তি উড়িয়ে দেন অভয়পদ । বললেন , ‘ চলুন বসা যাক । বাইরে হিমে থাকার দরকার কী ।
শ্মশানযাত্রীদের ছাউনির নীচে এক বেদীতে দুজনে জুত করে বসল । একটু বাদেই অন্ধকার হয়ে গেল চরাচর ।
নরহরির আসার কথা রাত বারােটা নাগাদ । এখনাে ঘণ্টাচারেক বাকি । এতক্ষণ কী করে কাটাই ? পিনপিন করে ধেয়ে এল মশার ঝাক । দীপক মুখে ঘাড়ে হাতে পায়ে মশা তাড়ানোের তেল মেখে নিল । অভয়পদবাবুকে অফার করল , এই তেল মেখে নেবেন নাকি ? মশা পালায় ।
‘দরকার নেই । ‘ জবাব দিল অভয়পদ । তিনি সর্বাঙ্গ চাদর মুড়ে বসেছে ।
ফ্লাস্ক থেকে একটু চা ঢালল দীপক । অভয়বাবুকে জিজ্ঞেস করল , ‘ চা খাবেন ?
‘ এখন থাক ।’
দীপক জোরাজুরি করল না । আসল কারণ , চা পানের পাত্র যে মাত্র একটি । ফ্লাস্কের মাথায় পেয়ালার মতন ঢাকনাটা । একই পাত্রে দুজনে চমক দিতে প্রবওি হয় না । চা পান শেষ হলে দীপক ঠেস দিয়ে বসল দেয়ালে । চারধার নিঝম হয়ে গেছে । অদৃশ্য কারণে বিচিত্র সব খসখস , সরসর শব্দ ; শেয়াল কুকুর বা অন্যান্য জীবের প্রায় নিঃসাড়ে শ্মশানভূমিতে বিচরণের আভাস । কখনাে তাদের চাপা গর্ভানি কানে আসে । নিকষ কালাে আকাশে ফুটেছে অসংখ্য গ্রহ – নক্ষত্র । তারার আলােয় এবং ক্ষীণ জ্যোৎস্নায় চারদিক অস্পষ্ট , রহস্যাবৃত । গাছপালা ঝােপঝাড়গুলােকে দেখাচ্ছে যেন জমাট কালাে ছােট – বড় স্তুপ । দূরে ধুসর নদীচর । টুকরাে টুকরাে ছায়ার মতাে আকাশে মাঝে মাঝে ভেসে যাচ্ছে রাতচরা পাখি । চোখ – কান উন্মুখ রেখে দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে দীপকের রীতিমত গা ছমছম করতে লাগল । সে চোখ দুটি বাদে আপাদমস্তক ঢেকে দেয় চাদরে ।
অভয়বাবু নিথর । মনে হলাে ঢুলছেন । এমন একটি অপ্রত্যাশিত সঙ্গী পেয়ে দীপক নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করে । নইলে এমন ভয়াবহ নির্জন জায়গায় একা এতক্ষণ কাটানাের অভিজ্ঞতা হয়তাে মর্মান্তিক হতাে । ক্রমে তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে ।
সহসা একটা চটকা দিয়ে দীপক সজাগ হয়ে ওঠে । সারা গায়ে শিরশিরে অনুভূতি ।
আমি কোথায় ? এই উপলব্ধিটা পরিষ্কার হতে তার কিছুক্ষণ লাগে । আস্তে আস্তে সব মনে পড়ে । পাশে তাকিয়ে দেখে অভয়পদবাবুর নিশ্চল মূর্তি । নিশ্চয় ঘুমােচ্ছন ঠেস দিয়ে বসে । সে চোখ টান করে সামনের দিকে তাকায় ।
কৃষ্ণপক্ষের আঁ আঁ নিশুতি রাত । শশান আরও অলৌকিক ভূতুড়ে হয়ে উঠেছে ।
ঘষা কাচের মধ্য দিয়ে স্বল্প আলাে যেমন দেখায় তেমনি ক্ষীণ হলদে আভা প্রান্তরব্যাপী । গাঢ় কালাে আঁধার সামান্য ফিকে হলেও কিছুরই রূপ ঠিকঠাক ঠাহর হয় না । সবই আবছায়া । সম্মুখে একটা শিমূল গাছকে বিশাল এক কৃষ্ণকায় দৈত্যের মতাে দেখাচ্ছে ।
– কান পাতলে কত অদ্ভুত অজানা শব্দ ধরা পড়ে । অন্ধকারের জীবরা এখন জাগ্রত । ওরা সবাই কি শরীরী ? নাকি অশরীরী অন্য জগতের কায়াহীনরাও রয়েছে ? কখনাে উঠেছে সাঁ সাঁ ধ্বনি । যেন অতৃপ্ত আত্মাদের দীর্ঘশ্বাস । কখনাে শােনা যাচ্ছ যেন চাপা গােঙানি । কখনাে বা মনে হচ্ছে কলকণ্ঠের অস্ফুট ঝঙ্কার । এমনি অনেক অজানা ভয় জাগানাে আওয়াজ । দীপক ফের ভাবে , এই মহাশ্মশানে নিঃসঙ্গ রাত্রিযাপন কি ভয়াবহ । ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায় , অভয়পদকে জুটিয়ে দেবার জন্য । রেডিয়াম লাগানাে ঘড়ির কাটায় দেখে রাত প্রায় দশটা ।
সহসা পিছন থেকে দীপকের ঘাড়ের ওপর ফেঁস করে কেউ নিঃশ্বাস ফেলল ! সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক কনকনে বায়ু তার চাদর ফুড়ে স্পর্শ করল দেহ । সারা গা কাটা দিয়ে উঠল । ঘাড় থেকে শরীর বেয়ে নেমে গেল একটা হিমশীতল স্রোত । অবশ হয়ে যেতে লাগল তার দেহ । প্রচণ্ড আতঙ্কে দীপক পিছনে ফিরে তাকাবার সাহস হারিয়ে ফেলল । পরপর দু তিনটে এমনি দীর্ঘশ্বাসের ছোঁয়ায় সে শিউরে শিউরে উঠল । তারপর মরিয়া হয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় ভাঙাভাঙা কণ্ঠে ডাক দিল , অভয়বাবু ।
‘ উ । সাড়া মিলল ।’
‘ আমার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলল কেউ । উঃ কি ঠাণ্ডা ! ‘
‘ পেছনের দেয়ালের ফাটল দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকে লেগেছে ’ , নির্বিকার স্বরে জবাব দিলেন অভয়পদ ।
ঘাড় ফিরিয়ে দেখে দীপক বুঝল অভয়পদর কথাই ঠিক । টের পেল স্থান কালের মাহাত্ম্য । তেমন পরিস্থিতিতে বুদ্ধি বিবেচনা কেমন ভাবে লােপ পায় । ভয় গ্রাস করে মনকে । সে বুঝল যে অভয়পদ বিলক্ষণ সাহসী ব্যক্তি এবং এমন নির্জন অস্বাভাবিক স্থানে রাত কাটানাের অভিজ্ঞতা আছে ।
‘ চা খাবেন ? প্রশ্নটা অভয়বাবুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পাশে রাখা ফ্লাস্কের তল্লাশে টর্চ জুলতেই — “ আঃ আলাে নেবান ! ‘ চাপা কণ্ঠে ধমকে উঠলেন অভয়পদ । সঙ্গে সঙ্গে বললেন , ‘ নদীর দিকে দেখুন ।
অবাক হয়ে দীপক দূরে নদীর পানে খানিকক্ষণ খর দৃষ্টি মেলে আবিষ্কার করল , আধাে অন্ধকার বালুচরে এক জায়গায় কয়েকটা লাল আলাের বিন্দু । ছায়া ছায়া কয়েকটা মূর্তি যেন ঘন হয়ে রয়েছে ওখানে !
“ কি ওগুলাে ? দীপক ভয়ে ভয়ে বলে ।”
‘ বিড়ি খাচ্ছে কারা । মনে হচ্ছে বদলােক । ডাকাত ! ফিসফিসিয়ে জানালেন অভয়পদ ! তারপর নিচু স্বরে বললেন , ‘ মুশকিল করল ! একটু বাদে হয়তাে নরহরি আসবে আলাে নিয়ে । ডাকাতগুলাে দেখতে পাবে । ভাববে ওদের ফলাে করতে এসেছে । তীর বা গুলি ছুঁড়তে পারে নরহরিকে । আপনি বসুন । দেখি কি করা যায় ? ’ অভয়পদ নিঃশব্দে উঠে বাইরে অদৃশ্য হলেন । আতঙ্কিত দীপক বসে থাকে ।
মিনিটখানেক বাদেই শ্মশানপ্রান্তে নদীর ধারে উঁচু পাড়ের মাথা থেকে ভেসে এল । এক অপার্থিব রব — খনখনে তীক্ষ্ণ সুরে টানা হাসির ঢেউ কেঁপে কেঁপে উঠে ফালাফালা করে দিল আঁধার রাতের নীরবতা । যেন তা কোনাে উন্মাদ ব্যক্তি বা কোনাে প্রেতলােকের বাসিন্দার বিকট উল্লাস ধ্বনি । হাসিটা শােনা গেল মাত্র একবার ।
আচমকা এই ভয়ানক হাসি শুনে কাঠ হয়ে গেল দীপক । সে দেখতে পেল , নদীচরে ছায়ামূর্তিগুলি আর্তনাদ করে উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে মারল দৌড় । মিলিয়ে গেল দূরে !
বেটারা পালিয়েছে । ছাউনিতে ঢুকে খিকখিক করে হেসে বললেন অভয় মণ্ডল ।
বেদীতে ফের বসে বললেন , “ আজ আর ওদের ডাকাতি করা সাহসে কুলােবে না । দীপক টোক গিলে বলে , ‘ উঃ কি একখানা হাসি দিলেন । আমি অবধি আঁতকে উঠেছিলুম ! বাপরে !
‘ যাত্রায় শেখা ’ , ‘ খুক করে হেসে বললেন অভয়পদ , অনেক রকম হাসি কান্না জানা আছে । তা আওয়াজটা কি পলাশডাঙ্গা অবধি পৌছেছে ? তাহলে তাে আর নরহরি এমুখাে হবে না । দেখা যাক !
দীপক এক প্রস্থ চা খেল । অভয়পদ ফের ঝিমুতে শুরু করলেন । ওঁর সঙ্গে কয়েকবার কথাবার্তা চালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাে দীপক । শ্মশান ও নদীতীর আবার নিথর রহস্যময় পরিবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । দীপক চুপচাপ জেগে থাকে ! গা ছমছমে ভাবটা অনুভব করলেও আগের সেই প্রচণ্ড অস্বস্তি ও ভয়ের অনুভূতিটা আর নেই । বােধহয় এমন একজন বেপরােয়া সঙ্গী পাশে থাকার কারণেই ।
প্রায় সাড়ে এগারােটা নাগাদ দীপক দেখল পলাশডাঙ্গার দিক থেকে এগিয়ে আসছে । একটা টর্চের আলাে ।
‘ অভয়বাবু ’ , ডাকল দীপক , নরহরি বােধহয় আসছে ।
হুম । অভয়পদ খাড়া হয়ে বসেন ।
শ্মশানযাত্রীদের ছাউনিটার খানিক তফাৎ দিয়ে শ্মশানে ঢুকল নরহরি , সে খুব ধীরে ধীরে এগুচ্ছে , আশেপাশে বারবার টর্চ ফেলে তাকাতে তাকাতে অতি সন্তর্পণে । থমকে দাঁড়াচ্ছে মাঝে মাঝে ।
‘ বেশ ভয়ে ভয়ে যাচ্ছে । নিচু সুরে মন্তব্য দীপকের ।
‘ হুঁ ! ’ সায় দিলেন অভয়পদ ।
শ্মশানের একেবারে মাঝখানে গিয়ে থামল নরহরি , যেখানে শবদাহ করা হয় সেখানে । দেখা গেল কী যেন একটা বাঁধল খুঁটিতে । তারপর ফিরে চলল । কিন্তু মাত্র কয়েক পা গিয়েই একবার আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সে । হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে নিভে গেল টর্চটা । ব্যস , আর কোনাে সাড়াশব্দ নেই ।
উত্তেজনায় টানটান হয়ে দেখছিল দীপক । নরহরি পড়ে যেতেই সে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু ইতস্তত করছিল ওদিকে এগুতে ।
‘ আসুন শীগগির । দীপকের পাশ দিয়ে দ্রুতপায়ে নরহরির দিকে যেতে যেতে ডাক দিলেন অভয়পদ । দীপক তার পিছু নিল ।
নিস্পন্দ নরহরি মাটিতে পড়ে আছে চিৎ হয়ে । চোখ বন্ধ । অভয়পন নরহরির বুকে একটু হাত রেখে বললেন , ‘ বেঁচে আছে ‘। তবে অজ্ঞান হয়ে গেছে । আমি আসছি এক্ষুণি । তিনি প্রায় ছুটে নেমে গেলেন নদীর ঢালে । হতভম্ব দীপক দাঁড়িয়ে থাকে ।
খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন অভয়পদ । তার হাতে মাটির হাঁড়িতে জল । বললেন , ‘ ওর চোখে মুখে জল দিন ।
দীপক তার নির্দেশমতাে জলের ঝাপটা দেয় নরহরির মুখে ।
অভয়পদ নরহরির টর্চটা কুড়িয়ে আনেন । কাঁচ ভেঙে গেছে টর্চের । অভয়পদ এবার নিচু হয়ে বসে নরহরির ধুতি – জামা পরীক্ষা করে বললেন , ‘ ও , এই ব্যাপার । দেখুন , ধুতিতে একটা কাটা গাছের ডাল আটকে গেছে । আচমকা পেছন থেকে ধুতিতে টান পড়ায় নরহরি ঠিক ভেবে বসেছিল ভূতটুত কেউ টানছে তাকে । ভয়ে কাটা হয়েছিল , তাই ওই চিন্তাটাই প্রথম উদয় হয় । তারপরই হোঁচট খায় । ফলে জ্ঞান হারায় । নরহরি মােটেই সাহসী নয় । ঝোকের মাথায় এসেছিল বটে , তাই সামান্য কারণেই এমন শক পেয়েছে । মিনিট পনেরাে বাদে নরহরির চোখের পাতা একটু কাপল । ওর বােধহয় চেতনা ফিরে আসছে । এই সময় দেখা গেল দূরে পলাশডাঙ্গা গ্রামের দিক থেকে এগিয়ে আসছে টর্চ ও লণ্ঠন হাতে কয়েকজন লােক । শ্মশান এলাকায় সীমানায় এসে তাদের । একজন চিৎকার করল , নরহরি ও ন – র – হ – রি ।
অভয়পদ দীপককে বললেন , ‘ সাড়া দিন । ‘
দীপক হেঁকে জবাব দিল , “ এই যে । এদিকে ।”
অভয়পদ আগন্তুকদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নিয়ে দীপককে বললেন , ‘ গােলকপতির গলা ।’ শুনুন , আপনি গােলােককে বলবেন যে এমন বাজি ওরা যেন আর কক্ষনাে না ধরে । সবার নার্ভ সমান নয় । অনেক বােকা নিজের এলেম বােঝে না । ফলে বাহাদুরি করতে গিয়ে ভীষণ বিপদ ডেকে আনে । তাই কোনাে লােককে তাতিয়ে দিয়ে এমন ব্যাপারে ঠেলে দেওয়া উচিত নয় । বলে দেবেন ।
‘ আপনি নিজেই বলুন না । ঠিকই তাে বলছেন , ‘ বলল দীপক ।
‘ নাঃ , আমি যাচ্ছি । ” বলেই দীপককে আর কিছু বলার সুযােগ না দিয়েই অভয় মণ্ডল হনহন করে নদীর দিকে হেঁটে গিয়ে অদৃশ্য হলেন ।
লােকটির আচরণে খুব অবাক হয় দীপক । কি ব্যাপার । মনে হলাে গােলকপতিদের সঙ্গে কথা বলতে ওঁর আপত্তি আছে ।
যা হােক , এ নিয়ে ভাববার অবকাশ পেল না দীপক । গােলােকপতি ঘটনাস্থলে এসে পড়ল আরও দুজন সঙ্গী নিয়ে । তিনজনেই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল , কী হয়েছে নরহরির ?
দীপক বলল , ‘ অজ্ঞান হয়ে গেছেন ভয় পেয়ে । তবে জ্ঞান ফিরেছে । ‘
নরহরি সত্যি তখন চোখ খুলেছে । ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ।
গােলকপতির মনােযোেগ এবার দীপকের দিকে ফেরে । ভুরু কুচকে বলল , “ আপনি এখানে ! আপনি শিবপদর জ্ঞাতি , তাই না ? এত রাতে এখানে কী করছেন ?
দীপক বুঝল এবার আত্মপ্রকাশ করা উচিত । সে একটু হেসে বলল , “ আমি একজন রিপাের্টার । আপনাদের বাজির ব্যাপারটায় কী ঘটে দেখতে এসেছিলুম । আপনি তাে গােলােকবাবু ?
‘ আমাদের বাজি ! ’ গােলােকপতি চমকায় , কে বলল ? ”
‘ আজ্ঞে আমার কাগজ বঙ্গবার্তার এডিটর শ্রীকুঞ্জবিহারী মাইতি । উনিই নিউজটা কভার করতে আমায় পাঠিয়েছেন এখানে ।
‘ ও’ । গােলােকপতি আর এ নিয়ে কথা বাড়ায় না । ওরা তিনজন নরহরিকে তুলে বসিয়ে ওর চুল , মুখ , ঘাড় – গলা মুছিয়ে দেয় । নরহরির ভাব দেখে মালুম হলাে তার যেন ঘাের কাটছে । সে ভীতচকিত দৃষ্টিতে চাইতে থাকে চারধারে । তাকে তুলে দাঁড় করায় গােলকপতি ।
এবার দীপক তাকে বলে , ‘ গােলােকবাবু , একটা অনুরােধ মানে অভয়পদবাবু বলছিলেন যে এমন বাজি না ধরাই ভাল । সবার নার্ভ তাে সমান স্ট্রং হয় না । ভয় পেয়ে ডেঞ্জারাস অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে ।
গােলােকপতি বাঁকা চোখে চেয়ে বলল , অভয়পদ ? কে ‘ অভয়পদ ?
আজ্ঞে অভয়পদ মণ্ডল । বললেন , এখানেই থাকেন । দীপক জানায় ।
অভয় মণ্ডল ! কখন বলল আপনাকে ? গােলােকপতির প্রশ্নের ধরন দেখে মনে হলাে যে এই জ্ঞান দেওয়া তার মােটেই পছন্দ হয়নি ।
‘এই একটু আগে ’ , জানাল দীপক , আমার সঙ্গেই এতক্ষণ শ্মশানে ছিলেন । আপনাদের আসতে দেখে চলে গেলেন ।
‘ ও এই বাজির কথা জানল কী করে ?
‘ আমি বলেছি । ‘ জবাব দেয় দীপক ।
‘ নেতাই , অভয় কলকাতা থেকে কখন ফিরেছে ? গােলােকপতি তার এক সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করে ।
নেতাই ওরফে নিতাই রায় ভারি অবাক সুরে বলল , কী জানি । আজ সন্ধ্যার সময় ততা ওর বাড়িতে খোঁজ করেছিলেম , বাড়ির লােক বললে এখনাে ফেরেনি ।
‘ অভয়পদর চেহারাটি কেমন বলুন দেখি ? ’
সন্দিগ্ধ সুরে জানতে চাইল গােলােকপতি ।
দীপক সাধ্যমতাে বর্ণনা দেয় অভয়পদ মণ্ডলের । দীপকের বর্ণনা শুনেই কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল গােলােকপতিরা তিনজন , এমনকি নরহরি অবধি । তারা চারজনে চোখাচোখি করে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে । তারপর গােলােকপতি দীপকের পানে চেয়ে বিরস কণ্ঠে বলল , ও আমাদের গাঁয়ের অভয়পদ মণ্ডল নয় , মনে হচ্ছে মধুপুরের অভয়পদ মণ্ডল । পরক্ষণে সে ধমকে তাড়া লাগাল সঙ্গীদের ‘ চ চ ‘।
চারজন হনহন করে হাঁটা দিল পলাশডাঙ্গার দিকে ।
অগত্যা দীপক পিছু নিল তাদের । সে বুঝল যে কোথাও একটা গণ্ডগােল রয়েছে । বােধহয় মধুপুরের অভয় মণ্ডলের সঙ্গে এদের বনিবনা নেই । তাই কেউ কারও মুখােমুখি হতে চায় না । এই ঝগড়ার হেতুটা কি আমাকে জানতেই হবে । হয়তাে লেখায় সেটা বেশ কাজে দেবে ।
গ্রামের কাছাকাছিদিয়ে থমকে দাঁড়াল গােলকপতি । দীপককে উদ্দেশ্য করে ফ্যাসফেসে গলায় বলল , ‘ সাত বছর আগে মধুপুরের অভয় মণ্ডল বাজি রেখে এই শ্মশানে এসেছিল এক অমাবস্যার গভীর রাতে । ফিরতে না দেখে ঘণ্টা দুই বাদে ওর গাঁয়ের লােকেরা শ্মশানে এসে আবিষ্কার করে ওর মৃতদেহটা । ডাক্তার বলেছিলেন — হঠাৎ ভয় পেয়ে হার্টফেল করেছে ।’