ভূতের গল্প : অন্ধকার সিঁড়ি

সে আজ বেশ কয়েক বছর আগের কথা। এই
কলকাতা শহরেই আমার জীবনে এমন একটা
অভিজ্ঞতা হয়েছিল যা মনে পড়লে এখনো
আমার গায়ে কাঁটা দেয়!
তখন আমার বয়স কতই বা হবে? বড়জোর একুশ কি বাইশ। বি.এ. পাশ করে চাকরীর জন্য
হন্যে হয়ে ঘুরছি। কোথাও চাকরী পাই না।
শেষে একদিন পিসেমশাইয়ের কাছে
গিয়ে দেখা করলাম। পিসেমশায় একটা
বড় কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
সব শুনে তিনি আমায় ওঁর অফিসে এসে
দেখা করতে বললেন। সেইমতো আমি
একদিন ওঁর অফিসে যাবার জন্য তৈরি
হলাম।
দিনটা খুবই বাজে ছিল। একে পৌষ মাসের
শেষ, তার ওপর বেশ কয়েকদিন ধরে
ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলছিল নাগাড়ে। সঙ্গে
হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা। সেদিন সকালে
বৃষ্টিটা একটু ধরেছিল, কিন্তু আকাশটা
ছিল গোমড়া মুখের মতো মেঘলা করে।
মাঝেমাঝেই ঝোড়ো বাতাস। ঠাণ্ডায়
শীতবস্ত্র ভেদ করেও গায়ে যেন ছুঁচ
বিঁধছিল। দুটো কান যেন কেউ বরফের ছুরি
দিয়ে কেটে নিচ্ছিল। বেরোচ্ছিলাম,
আমার ছ’বছরের ভাইপোটা কোট আর
মাংকি ক্যাপ পরে সামনে এসে দাঁড়াল।
মাংকি ক্যাপ পরে তাকে কেমন
দেখাচ্ছে, সেটা প্রকাশ করার জন্য ও
আমার সামনে এসে নানারকম অঙ্গভঙ্গি
করতে লাগল। ওকে আদর করে বেরোতে
যাচ্ছিলাম, ও জিজ্ঞেস করল – “তোমার
মাংকি ক্যাপ নেই, কাকু?”
তা বটে। আমার মাংকি ক্যাপটা তো
ট্রাঙ্কে পচছে। বড় একটা ব্যবহার করা হয়
না। আজকের ওয়েদারেও যদি ব্যবহার না
করি তাহলে আর কবে ব্যবহার করব? আমি
তখন আবার ফিরে গিয়ে ট্রাঙ্ক থেকে
মাংকি ক্যাপটা বের করে সাইডব্যাগে
পুরে রাখলাম। দরকারে ব্যবহার করব।
পিসেমশাইয়ের অফিসটা পার্ক স্ট্রিট
আর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মুখে। মস্ত বড়
বিল্ডিং। তবে খুব পুরনো। বাইরে থেকে
বোঝার উপায় নেই। দিব্যি ঘষা-মাজা।
তবে অফিসটা খুব উঁচু তলায়। শুধু খুব উঁচুতে
লেখা ১৮৮০ সালটা দেখে বোঝা যায় কত
সালের পুরনো বিল্ডিং এটা।
বিল্ডিংটার নিচের তলায় সব দোকান।
আর পার্ক স্ট্রিটের দোকান মানেই বড় বড়
কেতাদুরস্ত ব্যাপার। বাড়ির ওপরতলাতে
যে নানা ধরনের অফিস রয়েছে, রাস্তা
থেকেই তা বোঝা যায়। ওদেরই মধ্যে
ছ’তলায় রয়েছে পিসেমশায়ের অফিস।
কিন্তু ঢুকব কোন দিক দিয়ে বুঝতে
পারলাম না – আশেপাশে শুধু দোকান আর
দোকান।
অনেক খোঁজ করে বিল্ডিংটার প্রায়
পেছন দিকে লিফটের সন্ধান পেলাম।
কিন্তু হায় – লোডশেডিং চলছে! লিফট
অচল। কাজেই সিঁড়ির দিকে এগোলাম।
ডান দিকে একটু এগিয়েই সিঁড়ি। এই সিঁড়ি
ভেঙেই আমায় ছ’তলায় উঠতে হবে।
লিফট যখন বন্ধ তখন সিঁড়িতে ভিড় হবার
কথা। কিন্তু সিঁড়িতে আমি ছাড়া
দ্বিতীয় কাউকে দেখতে না পেয়ে অবাক
হলাম। অবশ্য অবাক হবার কিছু ছিল না।
এই বিশ্রী ওয়েদারে হয়তো অনেকে বাড়ি
থেকে বের হন’নি। নিতান্ত দায়ে পড়ে
যারা বেরিয়েছিল, তারা লোডশেডিং
হবার আগেই ওপরে উঠে গেছে। কাজেই
আমি একাই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম।
সিঁড়ি যে এত অন্ধকার তা প্রথমে বুঝতে
পারিনি। তবু সাবধানে পা ফেলে ফেলে
উঠতে লাগলাম। সিঁড়িগুলো কাঠের আর
বেশ চওড়া। তাই রক্ষে। হোঁচট খাওয়ার ভয়
ছিল না। প্রথম প্রথম অন্ধকারে উঠতে বেশ
কষ্ট হচ্ছিল। পকেট থেকে লাইটার বের
করে জ্বেলে তার শিখার আলোয় যতটুকু
দেখা যায়, সাবধানে পা ফেলে ফেলে
উঠতে লাগলাম। তারপর ক্রমে অন্ধকারে
চোখ সয়ে এল। পনেরো কুড়ি ধাপ ওঠার পর
খানিকটা সমতল মেঝে। এটুকু বেশ হাঁটা
যায়। তারপর আবার খাড়া সিঁড়ি। বুঝলাম,
এই সমতল মেঝেগুলো একেকটা তলা
বোঝায়।
আমি ধীরেধীরে উঠছি। বাঁ দিকে
লিফটের গভীর অন্ধকার খাদ। অবশ্য পড়ে
যাওয়ার ভয় নেই। লোহার শিকের জাল
দেওয়া। ডান দিকে নিরেট দেওয়াল।
দেওয়ালটাকে মনে হচ্ছিল যেন পাহাড়ের
গা। কোথাও এতটুকু ফাঁকফোকর নেই।
আমি উঠছি তো উঠছিই।
সিঁড়িটা একে অন্ধকার তার ওপর নির্জন।
ভাবলাম এরকম জায়গায় তো কাউকে
ভুলিয়ে এনে দিব্যি খুন করা যায়।
ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
এমনি কতক্ষণ ধরে উঠছি জানি না, হঠাৎ
খেয়াল হলো, ক’তলা উঠলাম তা তো
হিসেব করিনি। ছ’তলা পার হয়ে যাইনি
তো? এটা মনে হতে আবার নিচের দিকে
নামতে লাগলাম। কি গেরো! নামছি তো
নামছিই। শেষে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে,
একটু দম নিয়ে আবার উঠতে লাগলাম।
এবার খুব হিসেব করে সিঁড়ি ভাঙতে
লাগলাম — এই হলো দোতলার মেঝে।
আরও কিছুক্ষণ ওঠার পর……এই হলো
তিনতলার মেঝে।….. এই-ই হলো চারতলা।
উঃ, এরই মধ্যে হাঁফিয়ে গিয়েছি!
কিন্তু এতক্ষণেও কাউকে সিঁড়ি ভাঙতে
দেখছি না কেন? না উঠুক, কেউ কি
নামবেও না? তবে কি অন্যদিকে আরও
কোনো সিঁড়ি আছে? আমি কি ভুল করে
পরিত্যক্ত কোনো সিঁড়ি দিয়ে উঠছি?
এ কথা মনে হতেই মাথাটা কেমন
ঝিমঝিম করে উঠল।
ঠিক এইসময়, ওপরের সিঁড়ি থেকে ভারী
জুতোর শব্দ শোনা গেল। কেউ যেন ভারী
ভারী পা ফেলে ওপর থেকে নেমে আসছে।
অবাক হয়ে তাকাতেই দেখি, স্যুট-টাই
পরা একজন সাহেব নামছে। তার টুপিটা
নেমে এসেছে প্রায় কপাল পর্যন্ত। দু-হাত
কোটের পকেটে গোঁজা।
কলকাতায় এখন বড় একটা সাহেব-মেম
চোখে পড়ে না। আজ হঠাৎ চোখের সামনে
এরকম একজন সাহেব দেখে অবাক হলাম।
সাহেব ততক্ষণে প্রায় আমার ঘাড়ের ওপর
এসে পড়েছেন। অথচ পাশে নামার জন্য
যথেষ্ট জায়গা আছে।
যেহেতু আমরা এখন স্বাধীন দেশের
নাগরিক, তাই সাহেব দেখে ভয় পেলাম
না। বেশ বিরক্ত হয়ে বললাম – “সাহেব,
লোকের গায়ের ওপর এসে পড়ছ কেন?
দেখেশুনে নামো”।
সাহেব আমার দিকে ফিরে তাকাল। উঃ!
কি ভয়ঙ্কর দৃষ্টি! আর চোখদুটো! ও কি
মানুষের চোখ! আমি কোনোরকমে পাশ
কাটিয়ে দৌড়ে তিন ধাপ ওপরে উঠে
গেলাম। তারপর আন্দাজে তলা হিসেব
করে ওপরে উঠতে লাগলাম। কিন্তু মনটা
কিরকম যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। ওপরে
উঠতে উঠতে হঠাৎই মনে হলো – ‘এইমাত্র
যাকে দেখলাম, সে বোধহয় কোনো
স্বাভাবিক মানুষ নয়। এমনকি….এমনকি
বোধহয় মানুষও নয়! মানুষ নয় – কেননা যে
পায়ের শব্দটা ওপর থেকে শুনতে
পেয়েছিলাম, সাহেব পাশ দিয়ে যাবার
সময় সেই শব্দ কিন্তু আর শুনতে পাইনি।
মনে হলো, সাহেব যেন হাওয়ায় ভর করে
নেমে গেল।
এ কথা মনে হতেই আমার গায়ে কাঁটা
দিয়ে উঠল। মনে হলো, এই অন্ধকার
সিঁড়িতে আরও কোনো মারাত্মক ঘটনা
ঘটতে যাচ্ছে।
যাইহোক, সবেমাত্র আরও পাঁচ-ছ’ধাপ
উঠেছি, হঠাৎই আমার পা দুটো যেন
সিঁড়ির সাথে আটকে গেল। দু’চোখ ঠিকরে
বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো আমার।
দেখি, মাত্র কয়েক ধাপ ওপরেই একটা
লোক সিঁড়ির দেয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে
দু-হাত-পা সিঁড়িতে ছড়িয়ে,রক্তাক্ত
অবস্থায় ঘাড় কাত করে মরে পড়ে আছে।
তার গলা থেকে অবিরল ধারায় রক্ত ঝরছে!
এ দৃশ্য দেখে আমি ভয়ে চিৎকার করে
উঠলাম। কিন্তু আমার চিৎকার শুধু সিঁড়ির
চার দেওয়ালের মধ্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত
হয়ে ফিরে এল।
এ তো রীতিমতো খুন! আর এই খুন যে ওই
সাহেবটাই করে গেছে, তাতে কোনো
সন্দেহ নেই।
আমি ভাবতে লাগলাম এই মূহুর্তে আমার
কর্তব্য কি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা আমার
উচিতও নয়, কোনো কাজের কাজও নয়।
সাহেবটা তো পালিয়েছে। এখন নিচে
নেমে লোক ডেকে একে হাসপাতালে
দেওয়া উচিত।
এ কথা মনে হতেই আমি তরতর করে সিঁড়ি
দিয়ে নিচে নামতে লাগলাম। আমার
পায়ে যে এত জোর তা ভাবতে পারিনি।
কখনো কখনো আমি দু-তিন ধাপ সিঁড়ি
একসঙ্গে ডিঙিয়ে নামছিলাম।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একতলায় এসে
পৌঁছলাম। দিনের আলো দু’চোখ ভরে
দেখলাম। আমি এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে
“খুন…খুন” বলে চিৎকার করে দোকানগুলোয়
খবর দিতে লাগলাম। সঙ্গে সঙ্গে হৈ হৈ
করে লোক বেরিয়ে এল। তারা আমার
ভয়ার্ত মুখ দেখে বিপদের গুরুত্ব বুঝতে
পারল। উত্তেজিত হয়ে তারা আমায় ধরে
জিজ্ঞেস করল – “কোথায় খুন?…..কোথায়?

আমি আঙুল দিয়ে সিঁড়িটা দেখিয়ে
দিলাম। ওরা হৈ হৈ করে সেই সিঁড়ি
দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
এরপর আমি কি করব ভাবতে লাগলাম।
নাঃ, এখান থেকে কেটে পড়াই
বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এরপর পুলিশ
আসবে। কে প্রথম খুনটা দেখেছিল তাই
নিয়ে খানা-তল্লাশ হবে। আমি শুধু শুধু
জড়িয়ে পড়ব। তার চেয়ে কেটে পড়াই
ভালো।
এটা মনে হতে আমি পার্ক স্ট্রিট ক্রশ
করে উল্টোদিকের ফুটপাতে গিয়ে
উঠলাম।
এর পরেই হলো আমার মতিভ্রম। বাড়ি চলে
গেলেই হতো। কিন্তু খুনটা নিয়ে শেষ
পর্যন্ত কি হয়, তা দেখবার জন্য আমি
ওখানে দাঁড়িয়েই রইলাম।
এই ভেবে আবার রাস্তা পার হয়ে
বিল্ডিংটার দিকে এগোচ্ছি – কিন্তু মন
বলতে লাগল এটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না।
কারণ আমায় কেউ না কেউ চিনে
ফেলবেই। আর তখন জেরার মুখে পড়তে হবে
– কখন কি অবস্থায় মৃতদেহটা
দেখেছিলাম? খুন করে কাউকে পালাতে
দেখেছিলাম কিনা – ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমিই যে খুন করিনি তার প্রমাণ
কি?….শেষে হয়তো আমাকেই পুলিশি
ঝামেলায় পড়তে হবে।
তবু ব্যাপারটা কি হলো জানার জন্য
আমার এমনই কৌতূহল হলো যে রাস্তা পার
হয়ে সেখানে না গিয়ে পারলাম না।
সেইসময় হঠাৎ আমার মাংকি ক্যাপ’টার
কথা মনে পড়ে গেল। আমি ব্যাগ থেকে
ওটা বের করে নিয়ে মাথায় পরে নিলাম।
ফলে আমার মাথা, মুখ, কান, গলা – সব
ঢাকা পড়ে গেল। শুধু চোখদুটো বেরিয়ে
রইল।
বিল্ডিংটার সিঁড়ির সামনে গিয়ে
দেখি লোকে লোকারণ্য। আশ্চর্য!
ডেডবডিটা কোথাও নেই, খুনীকে ধরা তো
দূরের কথা! পুলিশও আসেনি – অথচ
লোকগুলো মারমুখো। মনে হলো যেন
কাউকে খুঁজছে।
একটু কান খাড়া করে থাকতেই শুনতে
পেলাম, একজন আরেকজনকে বলছে –
“কোথায় খুন? সব মিথ্যে!”
আমি অবাক হলাম। কেউ খুন হয়নি মানে!
তাহলে আমি যে দেখলাম কেউ একজন
সিঁড়িতে হাত পা ছড়িয়ে দেওয়ালে
ঠেসান দিয়ে বসে মুখ গুঁজে মরে পড়ে
রয়েছে! তার গলা থেকে দরদর ধারায় রক্ত
বেরোচ্ছে – এ’ও দেখেছিলাম!
তারপরেই যে কথাগুলো কানে এল, তা শুনে
আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। সবাই
উত্তেজিত হয়ে বলাবলি করছে – “সব
মিথ্যে! সেই ধাপ্পাবাজ ছোকরাটাকে
একবার পেলে হয়!”
আমি তখন বেপরোয়া হয়ে একজন বুড়ো
গোছের লোককে জিজ্ঞাসা করলাম – ”
কি ব্যাপার মশাই?”
সে বলল,”একটা ছোকরা হঠাৎ ওপর থেকে
নেমে এসে রটিয়ে দিল, সিঁড়িতে কে
একজন খুন হয়েছে। সবাই তার কথায় ওপরে
ছুটল। কিন্তু কোথাও কিছু নেই”।
মনে মনে ভাবলাম – ‘তাহলে তো সত্যিই
কেউ খুন হয়নি! কিন্তু তাহলে আমি তখন
কি দেখলাম!’
কিন্তু তা নিয়ে তখন আর মাথা ঘামাবার
সময় ছিল না। এক দল লোক কেবলই
চেঁচাচ্ছে – “কোথায় সেই ধাপ্পাবাজটা?
ধরো তাকে। নিশ্চয়ই সে বেশীদূর
পালাতে পারেনি!”
আরেকজন বলল, “ধরতে তো লোক ছুটেছে।
কিন্তু চিনবে কি করে?”
“….খুব চেনা যাবে”, একজন মস্তান গোছের
ছোকরা সোৎসাহে বলে উঠল – ” আমি
দেখেছি, তার কপালে একটা মস্ত আঁচিল
আছে”।
সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি মাংকি ক্যাপটা
কপালের ওপর আরেকটু টেনে ওখান থেকে
সরে গেলাম। এখুনি এখান থেকে পালাতে
হবে।
কিন্তু পালাব কোথায়? গলির মুখ থেকে
ফুটপাত পর্যন্ত ভিড়! সবাই বলছে – এরকম
ধাপ্পা দেবার কারণ কি? নিশ্চয়ই
কোনো বদ মতলব আছে। পাকড়াও করো
ওকে……কিন্তু কোনদিকে গেল?……কেউ
কেউ বলছে…..ওইদিকে গেল….ওইদিকে
গেল…..।
আমার হাত-পায়ের তখন প্যারালিসিসের
মতো অবস্থা। এখনও এত লোকজনের মধ্যে
থেকেও যে ধরা পড়িনি, তা স্রেফ এই
মাংকি ক্যাপটার জন্য।
কিন্তু লোকগুলো যেভাবে আমার দিকে
তাকাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ওরা
আমাকেই সন্দেহ করছে। একবার মাংকি
ক্যাপটা তুলে নিতে পারলে….. গেছি
আমি।
এই শীতেও সোয়েটার ভিজিয়ে ঘামছি।
কিন্তু পালাতে পারছি না। চারিদিকেই
ক্ষিপ্ত লোক।
আমার চোখমুখের যা অবস্থা, বেশ বুঝতে
পারছি কেউ ভালো করে আমাকে নজর
করলেই ধরে ফেলবে – আমিই সে।
হঠাৎ দেখলাম কয়েকজন লোক আমার
দিকেই এগিয়ে আসছে। কি করব ভাবছি,
কোথা দিয়ে পালাব ভাবছি – এমন সময়
হঠাৎ কারেন্ট এসে গেল। আমি
তাড়াতাড়ি লিফটের দিকে এগিয়ে
গেলাম। একটু পরেই লিফট চালু হলো। আমি
লিফটে গিয়ে উঠলাম। আমার সঙ্গে
কয়েকজন ভদ্রলোকও এসে উঠলেন । তারপর
পৌঁছে গেলাম ছ’তলায় মেসোমশাইয়ের
নিশ্চিন্ত হেফাজতে।
…………ঘটনাটা এখানেই শেষ হওয়া উচিত
ছিল কিন্তু তা যে হয়নি, সে শুধু আমার
কপালদোষে।
সাত দিন কেটে গেছে। কিন্তু এই সাতদিন
ধরে শুধু একটা কথাই মনে হয়েছে, সেদিন
অন্ধকার সিঁড়িতে যা দেখেছিলাম তা
সবই কি আমার চোখের ভুল ছিল? সেই যে
সাহেব, যার কপাল পর্যন্ত ঢাকা ছিল টুপি
দিয়ে, তার সেই হিংস্র ভয়ানক চোখ…..
সেই যে ঘাড় কাত করে পড়ে থাকা
মৃতদেহ…..সবই কি আমার চোখের ভুল?
শেষ পর্যন্ত আবার সেই সর্বনেশে কৌতূহল
আমার মাথায় চাড়া দিল। ঠিক করলাম,
আবার একদিন ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠব। দেখি,
আবার তেমন কিছু চোখে পড়ে কিনা।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ।
আবার একদিন সেই সিঁড়ির সামনে এসে
দাঁড়ালাম। আজ লোডশেডিং নয়।
চারিদিকে আলোয় আলো। লিফটও চলছে।
কিন্তু আবার সেই সিঁড়ি দিয়েই উঠতে
লাগলাম।
সিঁড়ি আজও নির্জন। লিফট থাকতে কেন
কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে? শুধু আমিই
একা উঠছি। সিঁড়ির প্রতিটি বাঁকে
আলো।
একতলা…দোতলা….তিনতলা করে উঠতে
লাগলাম। পাঁচতলার কাছে যেতেই থমকে
দাঁড়ালাম। কি করে, কেমন করে যেন মনে
হলো এটাই সেই জায়গাটা। ভালো করে
বোঝার জন্য দেওয়ালটার দিকে এগোচ্ছি,
যেখানে ডেডবডিটাকে সেদিন পড়ে
থাকতে দেখেছিলাম, ঠিক তখনিই
সিঁড়ির সব আলোগুলো নিভে গেল!
আমি নিশ্চিত এটা লোডশেডিং ছাড়া
কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়,কিন্তু তবু
গায়ে কেন যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে
হলো, অন্ধকার সমুদ্রে আমি যেন
দিশেহারা হয়ে গেছি। আর ঠিক তখনিই
একটা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া কোথা থেকে
যেন বদ্ধ সিঁড়িতে এসে আছড়ে পড়ল।
তারপরেই টের পেলাম বরফের মতো
ঠাণ্ডা একটা কঠিন হাত যেন আমার মুখ
চেপে ধরবার চেষ্টা করছে। আমি চিৎকার
করতে চাইলাম, কিন্তু গলা দিয়ে এতটুকু
স্বর বেরোল না।
তারপর কি করে যে নিচে নেমে
এসেছিলাম বলতে পারব না।
বাইরে তখন শেষ পৌষের মিষ্টি রোদ
ঝলমল করছে।
পরে পিসেমশাইয়ের কাছে শুনেছিলাম –
ঐ সিঁড়িতে এর আগেও দু-চারজন ওই দৃশ্য
দেখেছে। তবে একটি বিশেষ দিনে,
বিশেষ সময়ে ওই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
আমার দুর্ভাগ্য আমি সেই বিশেষ দিনের
বিশেষ সময়েই সেদিন ওই সিঁড়ি দিয়ে
উঠছিলাম। কিন্তু পরের দিনকার ঘটনাটা –
ওই যে ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া, বরফের মতো
ঠাণ্ডা হাতে মুখ চেপে ধরা……ওই
ব্যাপারটা কি?
না, বুদ্ধিতে কি সবকিছুর ব্যাখ্যা চাইলেও পাওয়া যায়না……

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page