ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় চার্লস উডের সুপারিশ সম্বন্ধে লিখুন

প্রশ্ন 5 : ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় চার্লস উডের সুপারিশ সম্বন্ধে লিখুন ।

উত্তর : ভারতে আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগটা ছিল সমস্যাবহুল যুগ । 1855 খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক গৃহীত সরকারি সিদ্ধান্তে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্বের সমাধান হয় । এতেই কিন্তু সব রকমের সমস্যার সমাধান হল না । তাই শিক্ষা সম্পর্কিত অসংখ্য প্রশ্ন ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে বড়ো হয়ে দেখা দিল । সেই সমস্যাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দেশীয় বিদ্যালয়গুলির পুনর্গঠনের সমস্যা , ভারতীয় ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম সমস্যা , দক্ষ কর্মী সম্বন্ধে সরকারের সমস্যা , সরকারি পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণের সমস্যা , বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মানগত সমতা বিধানের সমস্যা , মূল্যায়নের সমস্যা প্রভৃতি । এর মধ্যে 1853 খ্রিস্টাব্দে নতুন করে সনদ নবীকরণের সময় এল । তখন House of Commons- এর একটি নির্বাচিত কমিটি ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে তদন্ত করলেন । এই তদন্তের পরিণতি হল 1854 খ্রিস্টাব্দের ডেসপ্যাচ । নিয়ন্ত্রক বোর্ডের সভাপতি চার্লস উড-এর নামানুসারে একে উডের শিক্ষা দলিলও বলা হয়ে থাকে ।

উড-এর দলিলে গৃহীত ভারতীয় শিক্ষানীতি: উড-এর দলিল এদেশে কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি রচনা করেছে তা বিচার করতে গেলে আগে দেখতে হবে এতে শিক্ষা প্রসঙ্গে কী কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে । ভারতের তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব সমস্যার কথা প্রথমে বলা হয়েছে তাদের উপর ভিত্তি করেই একটি সর্বাত্মক শিক্ষা – পরিকল্পনা এই দলিলটিতে পরিস্ফুট হয়েছে ।

ভারতে শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্য: দলিলটির প্রথমেই বলা হয়েছে কোম্পানি কী উদ্দেশ্যে ভারতে শিক্ষা সংগঠন গড়ে তুলেছে তার বর্ণনা । এর উদ্দেশ্য হল প্রয়োজনীয় জ্ঞান ভারতবাসীর পক্ষে হবে নৈতিক ও গণতান্ত্রিক আশীর্বাদস্বরূপ । পাশ্চাত্য শিক্ষাই সরকারি কর্মচারী তৈরি করবে । ফলে এই শিক্ষাই ভারতবাসীর মধ্যে বাণিজ্য ও সম্পদ বৃদ্ধি , চেতনা বৃদ্ধি করবে । এবং এদেশ থেকে ইংল্যান্ড লাভ করবে যন্ত্রশিল্পে কাঁচামালের সুনিশ্চিত জোগান । ভারতে তৈরি হবে বিলাতি শিল্পপণ্যের অফুরন্ত বাজার । ঘোষণা করা হল যে , শিক্ষার বিষয়বস্তু হবে উন্নত ইউরোপীয় কলা , বিজ্ঞান , দর্শন ও সাহিত্য—এককথায় পাশ্চাত্য জ্ঞান । এইভাবে শিক্ষা , বাণিজ্য ও চাকুরিকে এক বৃত্তে গ্রথিত করা হল ।

এর পরেই দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী শিক্ষা দ্বন্দ্বের কথা । হিন্দু ও মুসলিম শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রসারের প্রয়োজন আছে তা স্বীকার করে নিয়েও এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে যে , ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রসার করাই হবে ভারতীয় শিক্ষার লক্ষ্য ।

শিক্ষার বাহন : শিক্ষার বাহন সম্পর্কে এখানে সুপারিশ করা হয় যে , পাশ্চাত জ্ঞান প্রদানের মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি ও ভারতীয় ভাষা উভয় গ্ৰহন করা প্রয়োজন ।

শিক্ষা বিভাগ : বাংলা , বোম্বাই , মাদ্রাজ , উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাব—এই পাঁচটি প্রদেশে একটি করে শিক্ষা বিভাগ স্থাপন করা হবে । এই বিভাগের প্রধানকে বলা হবে ডাইরেক্টর অব্ পাবলিক ইন্সট্রাকশান (Director of Public Instruction or DPI) । এই বিভাগের অধীনে থাকবে একদল পরিদর্শক (Inspectors) । সংশ্লিষ্ট প্রদেশের শিক্ষাবিস্তারের পূর্ণ দায়িত্ব থাকবে এই বিভাগের ।

বিশ্ববিদ্যালয় : ইংরেজি ও উচ্চশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে কলকাতা ও বোম্বাই শহরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে । আরও বলা হয় যে , মাদ্রাজ বা অন্য শহরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্র থাকলে সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রধানত পরীক্ষা গ্রহণ ও ডিগ্রি প্রদান করা হবে , তবে যেসব বিষয়ে উচ্চতর পর্যায়ের পড়ার ব্যবস্থা নেই সেইসব বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য যোগ্য অধ্যাপক নিয়োগ করা যাবে । বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য একটি সিনেট থাকবে । এখানে থাকবেন একজন চ্যান্সেলর , ভাইস-চ্যান্সেলর এবং সরকারের কয়েকজন মনোনীত সদস্য ।

গ্রান্ড ইন এইড প্রথা (Grant-in-aid): দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে শিক্ষাবিস্তারে বেসরকারি প্রচেষ্টাকে সরকার শর্তসাপেক্ষে আর্থিক সাহায্য করবে এই শর্তগুলি হল—

(ক) ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে ।

(খ) স্থানীয় পরিচালনার ব্যবস্থা থাকবে ।

(গ) সরকারি পরিদর্শক থাকবেন এবং পরিদর্শকের নির্দেশ মেনে চলতে হবে ।

(ঘ) ছাত্রদের নিকট থেকে স্বল্প হলেও বেতন নিতে হবে ।

শিক্ষক-শিক্ষণ: শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয় । প্রশিক্ষণরত শিক্ষকদের বৃত্তির ব্যবস্থা থাকবে । শিক্ষকতা পেশাকে সরকারি অন্যান্য চাকরির মতো আকর্ষণীয় করার সুপারিশ করা হয় ।

জনশিক্ষা ব্যকথা: উড-এর দলিলে জনশিক্ষার প্রতি এযাবৎ যে প্রচন্ড অবহেলা করা হয়েছে তা স্বীকার করা হয়েছে । এর জন্য দায়ী করা হয়েছে ‘চুঁইয়ে পড়া নিতিকে’ । উচ্চশ্রেণিভুক্ত কতিপয় ব্যক্তিকে শিক্ষা দিলে সেই শিক্ষা যে নিম্নগামী হয়ে সাধারণের নিকট পৌছোবে এ ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে । জনশিক্ষার জন্য বেসরকারি প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয় , এর জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে । প্রতি জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে । প্রথম প্রয়োজন হল যথেষ্ট মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি করা । এখানে ইংরেজি ও মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করলে জনশিক্ষা প্রসার সহজ হবে । এর নীচে থাকবে যথেষ্ট সংখ্যক প্রাথমিক ও দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান । এখানে মাতৃভাষা হবে শিক্ষার বাহন যাতে দ্রুতগতিতে জনশিক্ষার প্রসার ঘটে ।

বৃত্তিশিক্ষা: দলিলে বৃত্তিশিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় । আইন , চিকিৎসা , সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুপারিশ করা হয় । এ ছাড়া শিল্প শিক্ষার জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় স্থাপনের কথাও উল্লেখ করা হয় ।

অন্যান্য সুপারিশ: দলিলে আরও কয়েকটি সুপারিশ উল্লেখযোগ্য । যেমন—

(ক) স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে গুরুত্ব আরোপ করার কথা বলা হয়েছে ।

(খ) মুসলিমদের শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ নজর দেবার কথা বলা হয়েছে ।

(গ) উচ্চতর চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের এবং নিম্নতম চাকরির ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের সুযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।

Related posts:

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবন কথা
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী : 2024
চন্দ্রযান-3 : চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণকারী প্রথম দেশ ভারত
GENERAL STUDIES : TEST-2
GENERAL STUDIES : 1
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স: 8ই সেপ্টেম্বর
'জ্ঞানচক্ষু' গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
তপনের জীবনে তার ছোটো মাসির অবদান আলোচনা করো।
সমান্তরাল আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝ ?
আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝায় ? এটি কয়প্রকার ও কী কী ?
একটি সাদা কাগজকে কীভাবে তুমি অস্বচ্ছ অথবা ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যমে পরিণত করবে ?
ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অস্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অপ্রভ বস্তুও কি আলোর উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে?
বিন্দু আলোক - উৎস কীভাবে পাওয়া যেতে পারে ?
বিন্দু আলোক - উৎস ও বিস্তৃত আলোক - উৎস কী ?
অপ্রভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বপ্নভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
দিনেরবেলা আমরা ঘরের ভিতর সবকিছু দেখতে পাই , কিন্তু রাত্রিবেলা আলোর অনুপস্থিতিতে কোনো জিনিসই দেখতে পা...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page