প্রশ্ন : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ব্যবহৃত ন্যায় শব্দটির বিভিন্ন অর্থ ব্যাখ্যা করুন ।
উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ ন্যায় ’ শব্দটি তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে
(ক) সামাজিক ন্যায় (Social Justice)
(খ) অর্থনৈতিক ন্যায় (Economic Justice) এবং
(গ) রাজনৈতিক ন্যায় (Political Justice)
(ক) সামাজিক ন্যায় (Social Justice) : সামাজিক ন্যায় বলতে বোঝায় সমাজের প্রতিটি সদস্যকে সমমর্যাদা এবং সমসুযোগ প্রদান করা । এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল
(1) শিক্ষার দরজা সকলের জন্য উন্মুক্ত হবে ।
(2) প্রতিটি নাগরিক জ্ঞানের বিকাশ এবং আত্মবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা পাবে ।
(3) অস্পৃশ্যতাকে আইন দ্বারা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে ।
(4) সামাজিক স্তরবিন্যাস থাকবে না ।
(5) পশ্চাদবর্তীদের বিশেষ সুযোগ দিতে হবে ।
(6) কর্মে নিযুক্তির ক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার দিতে হবে ।
(খ) অর্থনৈতিক ন্যায় (Economic Justice) : ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার হিসাবে অর্থনৈতিক ন্যায়নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে । এখানে বলা হয়েছে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের অর্থ উপার্জন , অর্থসঞ্জয় এবং অর্থনৈতিক সুযোগ ভোগ করার অধিকার আছে । উপার্জনের জন্য ব্যাবসা বা কাজের অধিকার আছে ।
(গ) রাজনৈতিক ন্যায় (Political Justice) : রাজনৈতিক ন্যায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল—
(1) ভোটাধিকার ।
(2) সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ।
(3) নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার ।
(4) সরকার গঠনের অধিকার ।
(5) সরকারের বিরোধিতা করার অধিকার ইত্যাদি । এক শিক্ষার ক্ষেত্রে এই ন্যায়নীতির গুরুত্ব হল— প্রথমত , শিক্ষার্থীকে সু – নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সামাজিক , অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায়ের মূল্যবোধকে উৎসাহিত করতে হবে ।
সরকারি বিদ্যালয় : যে বিদ্যালয়গুলির আর্থিক দায়দায়িত্ব , প্রশাসনিক ব্যবস্থা ইত্যাদি সরকার কর্তৃক সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত হয় তাকেই সরকারি বিদ্যালয় বলে । দায়িত্ব যখন কেন্দ্রী সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে বলা হয় কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্যালয় এবং রাজ্য সরকারের হাতে থাকলে বলা হয় রাজ্য সরকারের বিদ্যালয় ।
আধা-সরকারি বিদ্যালয় : আমাদের দেশে অধিকাংশ বিদ্যালয়গুলি এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত । এখানে বিদ্যালয়গুলির আর্থিক দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ সরকার বহন করে । তবে বিদ্যালয়ের একটি পরিচালন সমিতি থাকে যারা বিদ্যালয় পরিচালন সংক্রান্ত দায়িত্বগুলি পালন করে ।
বেসরকারি বিদ্যালয় : এই বিদ্যালয়গুলির আর্থিক সংস্থান , পরিচালন ব্যবস্থা , শিক্ষক নিয়োগ সবই নির্দিষ্ট বিদ্যালয়গুলির দায়িত্ব । এই ধরনের বিদ্যালয়গুলিকে আবার কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় । যেমন—
(ক) ব্যক্তিভিত্তিক বিদ্যালয় : এখানে যে ব্যক্তি বিদ্যালয় স্থাপন করেছে তারই ইচ্ছানুযায়ী বিদ্যালয়ের আর্থিক সংস্থান , পরিচালনা , শিক্ষক নিয়োগ , তাদের স্থায়িত্ব সবই নিয়ন্ত্রিত হয় ।
(খ) সংগঠনভিত্তিক বিদ্যালয় : আমাদের দেশে এমন অনেক ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠন আছে যারা শিক্ষার প্রসারে বিদ্যালয় স্থাপন করে । যেমন- রামকৃষ্ণ মিশন , স্বামী দয়ানন্দ বিদ্যালয় , টাটা গোষ্ঠী এবং প্রেমজি গোষ্ঠী ইত্যাদি ।
(গ) এডুকেশান ট্রাস্ট : অনেক সংস্থা আছে যারা প্রথমে একটি আইন অনুযায়ী ট্রাস্ট গঠন করে । ওই ট্রাস্ট সমাজসেবামূলক একাধিক কাজ করে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শিক্ষার প্রসার । বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজ , যেমন — আর্থিক সংস্থান , পরিচালনা , শিক্ষক নিয়োগ তাদের চাকরির নিরাপত্তা ইত্যাদি ট্রাস্টের নিয়মানুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয় ।
(ঘ) ধর্মীয় সংগঠন : অনেক ধর্মীয় সংগঠন আছে যারা ধর্মীয় রীতিনীতি , আচার-অনুষ্ঠান বজায় রেখে শিক্ষার প্রসার করে । আমাদের দেশে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বিদ্যালয় , মাদ্রাসা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত ।
এছাড়া আরও কিছু বিদ্যালয় আছে সেগুলি হল—
শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব গ্রহণভিত্তিক বিদ্যালয় : এই ধরনের বিদ্যালয়কে দু-ভাগে ভাগ করা হয় । যথা—
(i) দিবা বিদ্যালয় : এই বিদ্যালয়গুলি দিনের নির্দিষ্ট সময় থেকে শুরু করে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় । বাড়ি থেকে যাতায়াত করে শিক্ষার্থী এই বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে ।
(ii) আবাসিক বিদ্যালয় : এইসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট বাসস্থানে থাকতে হয় । তাদের থাকা , খাওয়া , পঠন- পাঠন সবই বিদ্যালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয় ।
লিঙ্গভিত্তিক বিদ্যালয় : যে বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র বালকদের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থাকে তাকে বালক বিদ্যালয় বলে । একইভাবে যে বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র বালিকারা শিক্ষাগ্রহণ করে আবার যে বিদ্যালয়ে বালক এবং বালিকা উভয়েই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় তাদের যথাক্রমে বালিকা বিদ্যালয় এবং সহশিক্ষামূলক বিদ্যালয় বলে ।
সময়কালভিত্তিক বিদ্যালয় : যে বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায় তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয় বলে । যে বিদ্যালয়ে পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ আছে তাকে বলা হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় । এবং যে বিদ্যালয়ে পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ আছে তাকে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় বলে ।
প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনুমোদিত বিদ্যালয় : অনুমোদনের সংস্থাকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয়গুলিকে ভাগ করা যেতে পারে । যেমন—রাজ্য সরকারের নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদিত , CBSE এবং ICSE সংস্থা থেকে অনুমোদিত ।
অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক বিদ্যালয় : এই ধরনের বিদ্যালয়ের শ্রেণিবিভাগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
(i) কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় সংগঠন : যেসব কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের চাকরিতে স্থান পরিবর্তন করতে হয় (Transferable Job) তাদের সন্তানদের জন্য 1965 খ্রিস্টাব্দের 15 ডিসেম্বর থেকে চালু হয়েছে এই বিদ্যালয় । এটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একটি স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান ।
(ii) নবোদয় বিদ্যালয় বা পেস্ সেটিং বিদ্যালয় : এই ধরনের বিদ্যালয় স্থাপনের কথা জাতীয় শিক্ষানীতি (1986)-তে উল্লেখ করা হয়েছে । বিশেষ প্রতিভা বা প্রবণতাসম্পন্ন শিশুদের আর্থিক সংগতি বিবেচনা না করে যাতে তারা দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে সেজন্য উন্নতমানের শিক্ষার ব্যবস্থা করা । এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হল সমতা ও সামাজিক ন্যায় বজায় রেখে উৎকর্যের উদ্দেশ্য পূরণে জাতীয় সংহতির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চল থেকে প্রতিভাসম্পন্ন শিশুদের একত্রে বেঁচে থাকার শিক্ষা এবং তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ । বিদ্যালয়গুলি অবৈতনিক এবং আবাসিক হবে । এই ধরনের বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় থেকে পৃথক হবে ।
(iii) জাতীয় মুক্ত বিদ্যালয় : 1989 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতীয় মুক্ত বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে । বর্তমানে প্রায় সব রাজ্যে মুক্ত বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে । পশ্চিমবঙ্গে এই মুক্ত বিদ্যালয়ের নাম হল রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় । যেসব ব্যক্তি কোনো কারণে প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ পায়নি বা পাঠ ত্যাগ করেছে তাদের জন্য মুক্ত বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে , এটি দূরশিক্ষা ব্যবস্থার একটি শ্রেণি ।
সাধারণ বিদ্যালয় : কোঠারি কমিশন (1964) সাধারণ বিদ্যালয় বা Common School System সম্পর্কে সুপারিশ করে । সুপারিশে বলা হয় শিক্ষার সমসুযোগকে নিশ্চিত করতে সমগ্র দেশে এই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে । এই বিদ্যালয়গুলি উন্নতমানের হবে যাতে অভিভাবকগণ বেসরকারি ব্যয়বহুল বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভরতি করার প্রয়োজন বোধ না করেন । এজন্য কমিশন নিম্নে উল্লেখিত ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করার সুপারিশ করেন ।
(1) সরকারি বা বেসরকারি যে কর্তৃপক্ষেরই অধীনে কাজ করুক না কেন , সব শিক্ষকগণই বেতন সহ অন্যান্য সুবিধা সমানভাবে ভোগ করবেন । যেমন—
• সমান যোগ্যতা এবং দায়িত্বসম্পন্ন শিক্ষক সমবেতন পাবেন ।
• সব শিক্ষকই একই রকম অবসরকালীন সুযোগসুবিধা ভোগ করবেন ।
• চাকরির শর্ত এবং কাজের অবস্থা সব বিদ্যালয়ে একই হবে । চাকরিতে নিয়োগ পদ্ধতি একই হবে ।
(2) শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে বেতন ক্রমশ তুলে দেওয়া হবে চতুর্থ পরিকল্পনা শেষে প্রাথমিক স্তর থেকে এবং পঞ্চম পরিকল্পনার মধ্যে নিম্ন-মাধ্যমিক স্তরে আর বিদ্যালয়ে বেতন দিতে হবে না ।
(3) স্থানীয় সরকারি এবং বেসরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে কাজের সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে ।
(4) সুবিধাভোগী বিদ্যালয় এবং সাধারণ বিদ্যালয়ের মধ্যে বিভেদ ঘুচিয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য প্রতিবেশী বিদ্যালয় (Neighbourhood School) পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে ।
সাধারণ বিদ্যালয় ব্যবস্থা আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে খুবই প্রশংসনীয় সুপারিশ । কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল , তা মানা হয়নি । এর প্রধান কারণ হল আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য । সরকারি বিদ্যালয়ের ব্যবস্থার পাশাপাশি বেসরকারি বিদ্যালয় ব্যবস্থা থাকার জন্য বেসরকারি সংস্থা উন্নত পরিকাঠামো সহ অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের দ্বারা পঠনপাঠন ব্যবস্থা করতে সক্ষম । স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকগণ সন্তানদের উন্নতমানের শিক্ষার জন্য আগ্রহী এবং সেই কারণেই এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকা সত্ত্বেও অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের উন্নত পরিকাঠামোসহ উন্নতমানের বিদ্যালয় অর্থাৎ বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত অধিক বেতনের বিদ্যালয়ে ভরতি করান । এইভাবে সাধারণ বিদ্যালয়ের প্রতি জনসাধারণের আকর্ষণ দানা বেঁধে উঠতে পারেনি ।
প্রতিবেশী বিদ্যালয় ব্যবস্থা : আমাদের সমাজব্যবস্থায় অনেক বাধানিষেধ আছে । স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যালয়গুলিও এই বাধানিষেধের বেড়াজাল থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি । সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বাধানিষেধ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিকে আজও প্রভাবিত করে । জাতীয় সংহতি এবং ঐক্য স্থাপন এবং তাকে স্থায়ী করার জন্য এই বাধাগুলিকে উচ্ছেদ করা বিশেষ প্রয়োজন । শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের কৌশল হিসাবে গ্রহণ করলে এই বিধিনিষেধের বাধাকে সহজেই অতিক্রম করা যায় । প্রতিবেশী বিদ্যালয় ব্যবস্থা বলতে কমিশন বোঝাতে চেয়েছেন , প্রতিটি বিদ্যালয়ে সেই অঞ্চলের সকলের অর্থাৎ জাতি , ধর্ম , সম্প্রদায় আর্থসামাজিক ব্যবস্থা নির্বিশেষে পড়ার অধিকার থাকবে । কমিশন আরও বলেছেন যে , কুড়ি বছরের মধ্যে প্রতিবেশী বিদ্যালয় ব্যবস্থাকে সাফল্যমণ্ডিত করার সুপারিশ করেছে ।