প্রশ্ন : ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশু কাদের বলে ? এদের শ্রেণিবিভাগ করুন । ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার সমস্যা লিখুন । দৃষ্টিহীন শিশুদের শিক্ষণ পদ্ধতি আলোচনা করুন ।
উত্তর : ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশু : বিশ্বের প্রতিটি দেশেই অন্ধত্ব বা দৃষ্টিহীনতা একটি জটিল সমস্যা । বিভিন্ন দেশে দৃষ্টিহীনদের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । সাধারণভাবে যারা চোখে দেখতে পায় না , তাদের আমরা দৃষ্টিহীন বলি । শিক্ষাবিজ্ঞানে বলা হয়— A blind person is one , whose vision is so defective that he can not be educated through visual method অর্থাৎ শিক্ষাবিজ্ঞান অনুযায়ী , একজন দৃষ্টিহীন হল সেই ব্যক্তি , যাকে সাধারণ প্রদর্শন পদ্ধতিতে পাঠদান করা যায় না ।
ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের শ্রেণিবিভাগ : ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রে দুটি মতভেদ লক্ষ করা যায়—
(1) প্রচলিত শ্রেণিবিভাগ এবং
(2) মনোবিদ লোয়েনফেল্ড – কৃত শ্রেণিবিভাগ ।
প্রচলিত শ্রেণিবিভাগ : ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যেমন—
(1) সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন : যারা একেবারেই দেখতে পায় না এবং পড়াশোনার জন্য ব্রেইল প্রণালীর সাহায্য নিতে বাধ্য হয় , তাদের বলা হয় সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন । দৃষ্টিশক্তির প্রয়োজন হয় এমন কোনো কাজ তারা করতে পারে না । তারা শ্রবণ ও স্পর্শশক্তির উপর নির্ভরশীল হয় ।
(2) আংশিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন : যেসব শিশুর দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক শিশুদের থেকে দুর্বল এবং যারা বড়ো হরফের ছাপানো লেখা পড়তে পারে , কিংবা বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছু কিছু সাধারণ হরফের লেখাও পড়তে পারে , তাদের বলা হয় আংশিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ।
লোয়েনফেল্ড – এর শ্রেণিবিভাগ : মনোবিদ লোয়েনফেল্ড (Lowenfeld) ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের প্রধান চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন । এই চারটি শ্রেণি হল—
(1) জন্মগত দৃষ্টিহীন : যেসব ছেলেমেয়েরা জন্মগতভাবে পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই নিন সম্পূর্ণভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে , তারা এই শ্রেণিভুক্ত ।
(2) পাঁচ বছর বয়সের পর সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন : যেসব ছেলেমেয়েরা পাঁচ বছর বয়সের পর কোনো কারণে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে , তাদের এই শ্রেণিভুক্ত করা হয় । এইসব ছেলেমেয়েরা মানসিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্রথম শ্রেণির দৃষ্টিহীনদের থেকে অনেকটা আলাদা ।
(3) জন্মগতভাগে আংশিক দৃষ্টিহীন : এই ছেলেমেয়েরা জন্মগতভাবে আংশিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন হয়ে থাকে । এই ধরনের ছেলেমেয়েরা বড়ো হরফের ছাপানো অক্ষরের লেখা ছাড়া পড়তে পারে না ।
(4) অর্জিত আংশিক দৃষ্টিহীন : এই ছেলেমেয়েরা জন্মগতভাবে স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন হলেও পরবর্তীকালে কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা বা রোগব্যাধির কারণে আংশিকভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে ।
ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার সমস্যা : ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে নানাধরনের সমস্যা দেখা যায় । কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সংক্ষেপে আলোচনা করা হল—
(1) ইন্দ্ৰিয়জনিত সমস্যাঃ ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুরা স্বাভাবিক শিশুদের মতো লিখতে , পড়তে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে না । ফলে তাদের সামগ্রিক ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু ত্রুটি থেকেই যায় । এই ত্রুটির মূল কারণ হল দৃষ্টিশক্তির অভাব ।
(2) শিক্ষাজনিত সমস্যা : ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুরা স্বাভাবিক শিশুদের মতো নির্দিষ্ট বয়সে বিদ্যালয়ে ভরতি হয় না । বেশি বয়সে বিদ্যালয়ে আসার ফলে তারা এমনিতেই একই বয়সি স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় পিছিয়ে থাকে । এর ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের হীনম্মন্যতা দেখা দেয় , যা তাদের শিক্ষাগ্রহণে বাধার সৃষ্টি করে ।
(3) সামগ্রিক অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে সমস্যা : চোখ হল মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় । এটিকে জ্ঞানের সবচেয়ে মূল্যবান প্রবেশদ্বার বলা হয় । তাই ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুরা কোনো বিষয়ের সামগ্রিক অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হয় ।
(4) নিরাপত্তামূলক সমস্যা : ব্যাহত দৃষ্টিসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয় । আবেগজনিত কারণে অনেক সময় তারা ঠিকমতো নিজেদের চারপাশের পরিবেশ – পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না । অন্যের করুণা , বিদ্রূপ , তাচ্ছিল্য প্রভৃতি তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতাবোধের জন্ম দেয় । আর হীনম্মন্যতাবোধ তাদের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে । এর ফলে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে ।
আংশিক দৃষ্টিহীন শিশুদের শিক্ষণ পদ্ধতি আলোচনা করুন : যেসব শিশুর দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় দুর্বল এবং শক্তিশালী লেন্সের সাহায্যেও যারা স্বাভাবিকভাবে দেখতে পায় না , তাদের আংশিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন শিশু বলা হয় । এই আংশিক দৃষ্টিহীনতা জন্মগত হতে পারে , আবার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানান ধরনের শারীরিক রোগের কারণেও হতে পারে । আংশিক দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যেসব শিখন পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয় , তা নীচে আলোচনা করা হল—
(1) চশমা ব্যবহারের দ্বারা শিখন : আংশিক দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার জন্য ফ্রেশনেল ব্যালেন্স , গ্যালিলিয়ান চশমা প্রভৃতি ব্যবহার করা হয় । এ ছাড়া এই শিশুদের শ্রেণিকক্ষের প্রথম সারিতে বসিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয় ।
(2) বড়ো হরফের বইয়ের ব্যবহারের দ্বারা শিখন : আংশিক অন্ধদের শিক্ষাদানের সময় বড়ো হরফে ছাপানো বই ব্যবহার করা হয় । স্বাভাবিক শিশুদের জন্য ব্যবহৃত বইয়ে ছাপানো অক্ষরগুলি যেখানে 10 পয়েন্টের হয় , সেখানে আংশিক দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের জন্য 18 পয়েন্ট থেকে 24 পয়েন্ট – বিশিষ্ট অক্ষরে ছাপা বই ব্যবহৃত হয় । এইসব শিশুদের পড়ার সুবিধার জন্য হাসপাতাল এবং জেলা পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলিকে হ্যান্ড লেন্স এবং ম্যাগনিফাইং গ্লাস সরবরাহ করতে বলা হয় ।
(3) দর্শনে সহায়ক যন্ত্রের ব্যবহারের দ্বারা শিখন : এই পদ্ধতিতে উন্নতমানের লেন্স অথবা বৃহদীকরণের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রের সাহায্যে শিক্ষাদান করা হয় । এ ছাড়া এপিডোস্কোপের সাহায্যে বিভিন্ন পঠনীয় বিষয়কে পর্দায় বড়ো করে ফেলে আংশিক দৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিখনের ব্যবস্থা করা হয় ।
(4) শ্রুতিসহায়ক উপকরণের ব্যবহারের দ্বারা শিখন : শ্রুতিসহায়ক উপকরণ বলতে সাধারণত ফোনোগ্রাম , টকিং মেশিন , টকিং বুক , টেপরেকর্ডার , অডিয়ো – ক্যাসেট প্রভৃতিকে বোঝায় । এইসব উপকরণের সাহায্যে আংশিক দৃষ্টিসম্পন্ন শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয় । যেহেতু তারা চোখে ভালোভাবে দেখতে পায় না , তাই কানে শুনেই তাদের বেশিরভাগ পড়াশোনা করতে হয় ।
(5) শ্রেণিকক্ষে কিছু কৌশল প্রয়োগ : আংশিক দৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে সামনের সারিতে বসাবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন , যাতে তারা ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা দেখতে পায় । ব্ল্যাকবোর্ড দেখার সময় জানালার বাইরে যাতে মাঝে মাঝে তাকায় , সে ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে । ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার সময় শিক্ষক উচ্চারণ করে এবং বড়ো হরফে লিখবেন ।