প্রশ্ন : জ্ঞান নির্মাণ কীভাবে হয় উদাহরণসহ আলোচনা করুন । এই ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা লিখুন ।
উত্তর : জ্ঞান নির্মাণের ধারণাটি বহুলাংশে শিখনের নির্মিতিবাদের ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত । নির্মিতিবাদ হল মূলত একটি তত্ত্ব যা পর্যবেক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার উপর প্রতিষ্ঠিত । এটির মূল ভিত্তি হল ব্যক্তি তার নিজস্ব বোধগম্যতা ও জ্ঞান নির্মাণ করে বিভিন্ন বিষয়সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ও তার বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে ।
শ্রেণিকক্ষে এই নির্মিতিবাদী ধারণাটি বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয় । সাধারণভাবে এর অর্থ হল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সক্রিয় পদ্ধতি , যেমন — আবিষ্কার , বাস্তব সমস্যার সমাধান প্রভৃতি সক্রিয় পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে জ্ঞান অর্জনের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যে তারা কী করতে চাইছে এবং কীভাবে তাদের চিন্তাধারার পরিবর্তন হচ্ছে । কিন্তু এক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষককে নিশ্চিত হতে হবে যে তিনি শিক্ষার্থীদের পূর্বজ্ঞান সম্পর্কে জানেন এবং তার উপর ভিত্তি করেই নতুন জ্ঞান নির্মাণ করবেন । যে সমস্ত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান নির্মাণের উপর গুরুত্ব দেন তারা সকল সময় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মগুলি কীভাবে বোধগম্যতায় সহায়তা করছে তার বিচার করতে সহায়তা করেন । এইভাবে প্রশ্নকরণ ও বিভিন্ন বিষয় , কৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনার ফলে তারা ক্রমশ পারদর্শী হয়ে ওঠে । এই প্রক্রিয়া সবসময় তাদের জ্ঞান নির্মাণে বা জ্ঞানের গঠনের সঙ্গে জড়িত রাখে । এই ধরনের জ্ঞান নির্মাণের জন্য শ্রেণিকক্ষে কিছু পূর্বপরিকল্পনার প্রয়োজন হয় । এই বিষয়টিতে শিক্ষার্থীরা যখন ধারাবাহিকভাবে তাদের অভিজ্ঞতার উপর আলোকপাত করে তখন তারা ক্রমশ জটিল । বিষয়গুলির সম্পর্কে ধারণা লাভ করে এবং নতুন ধারণাগুলির সমন্বয়সাধনের জন্য ক্রমশ সক্ষম হয়ে ওঠে । শিক্ষকের মূল লক্ষ্যই হল যে শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়ায় উৎসাহিত করা এবং প্রয়োজনীয় আলোকপাত করা । উদাহরণস্বরূপ শ্রেণিকক্ষে প্রকৃতি বিজ্ঞানের পাঠের ক্ষেত্রে শিক্ষক পরিবেশের বাস্তব সংস্পর্শকে ব্যবহার করবেন । উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষা দেবেন ।
উদাহরণ : শিক্ষক প্রথমে বিভিন্ন বস্তু দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিকট একটি অনুসন্ধানের পরিবেশ সৃষ্টি করেন । এগুলি হল একই আকারের কতকগুলি ঘনক — কোনোটি কাঠের , কোনোটি লোহার , আবার কোনোটি ফোমের । এগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কিছু শিক্ষার্থী দেখল যে খুব ভারী বস্তুগুলি তাড়াতাড়ি নীচের দিকে পড়ে হালকাগুলির থেকে । এরপর শিক্ষক বিভিন্ন উপকরণ , যেমন — চার্ট , পোস্টার , ভিডিয়ো এগুলি শিক্ষার্থীদের দেখালেন এবং গ্যালিলিয়ো , নিউটন এদের সম্পর্কে বললেন । এরপর গ্যালিলিয়োর পরীক্ষাটির মতো শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ওজনের বস্তুগুলি নীচে ফেলল এবং তার পতনের সময় হিসাব করল । তারা দেখাল যে বিভিন্ন ওজনের বস্তুগুলি একটি গতিতে নীচে পড়ছে ।
শিক্ষকের ভূমিকা : নির্মিতিবাদ কখনোই শিক্ষকের ভূমিকাকে খর্ব করে না বরং এটা শিক্ষকের ভূমিকার সংস্কার করে যার ফলে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কিছু ঘটনার পুনরুৎপাদনের পরিবর্তে প্রকৃত জ্ঞান গঠনে সহায়তা করে । শিক্ষার্থীরা যখন গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলি নিয়ে আসে , শিক্ষক এগুলি বিশ্লেষণ করেন এবং শিক্ষার্থীরা যথাযথ প্রক্রিয়াগত পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে কিনা । তার পর্যালোচনা করেন । এই জ্ঞান নির্মাণের প্রক্রিয়ায় নির্মিতিবাদী শিক্ষকরা বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহার করেন , যেমন — সমস্যাসমাধানমূলক পদ্ধতি এবং অনুসন্ধানভিত্তিক পদ্ধতি । একটি যৌথশিক্ষণ পরিবেশে যে শিক্ষার্থীরা তার জ্ঞানকে প্রয়োগ করতে চায় ও ধারণাগুলির পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চায় ও তার থেকে নতুন ধারণায় উপনীত হতে চায় সেখানে এগুলি ব্যবহৃত হয়ে থাকে । জ্ঞান নির্মাণের এই প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীকে শিখনে একজন নিষ্ক্রিয় তথ্য সংগ্রহকারীর পরিবর্তে একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী করে তোলে । শিক্ষকের সহায়তায় শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে তাদের জ্ঞানের নির্মাণ করে । এক্ষেত্রে তারা যান্ত্রিকভাবে পাঠ্যবই মুখস্থ করার পরিবর্তে প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভে অংশ নিয়ে থাকে ।
এই ক্ষেত্রে শিক্ষকরা প্রশ্ন আলোচনা করেন এবং তারপর কীভাবে তারা নিজেদের উত্তর খুঁজে দেবে সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেন । শিক্ষকরা এই প্রক্রিয়ায় যে ভূমিকা পালন করেন তা হল—
1. শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব প্রশ্ন তৈরি করে শিক্ষক তাতে সহায়তা করেন ।
2. শিখনের বিভিন্ন ব্যাখ্যাকে ব্যক্ত করেন ।
3. দলগতভাবে কাজ করাকে গুরুত্ব দেয় । এই বক্তব্য অনুসারে জ্ঞান নির্মাণ করা যায় । কিন্তু শিক্ষার্থীরা তো শূন্যপাত্র নিয়ে আসে না , তাদের কিছু পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে । তাদের কিছু জ্ঞান , ধারণা ও বোধগম্যতা বর্তমান । তাদের পূর্ববর্তী জ্ঞান হল বর্তমান জ্ঞানের কাঁচামাল । শিক্ষার্থী হল সেই ব্যক্তি যে নিজের জন্য নতুন জ্ঞান নির্মাণ করে । শিক্ষক তাদের পরিচালনা , মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করেন , প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন এবং শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সহায়তা করেন ।
শিক্ষক এখানে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যাতে শিখন সম্ভব হয় । শিক্ষার্থী এখানে নির্ভাবনায় শিখতে পারে । এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের পূর্বজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কর্মপ্রদান করেন । এই শ্রেণিকক্ষ সকল সময় শিক্ষণের যৌথ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত । এটি যৌথ বা দলগত শ্রেণিকক্ষের কথা বলছে ।