জন ডিউই – র শিক্ষাদর্শন , শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে লিখুন ।
উত্তরঃ- ডিউই শিক্ষার সংজ্ঞা দান করতে গিয়ে এটিকে জীবনের নিরন্তর বৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা পুনর্গঠনমূলক প্রক্রিয়া রূপে বর্ণনা করেছেন । শিক্ষা ও জীবনকে তিনি একটি সমার্থক প্রক্রিয়া হিসাবে বিচার করেছেন । এই সংজ্ঞা অনুযায়ী শিক্ষা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া যা সার্থকতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে লাভ করা যায় । সুতরাং ডিউই অন্যান্য দার্শনিকদের ন্যায় শিক্ষার কোনো চরম লক্ষ্যের ধারণায় বিশ্বাসী নন । এর অর্থ হল , শিক্ষার লক্ষ্য শিক্ষা প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত সার্থকতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় । প্রয়োগবাদে বিশ্বাসী ডিউই জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে কোনো eternal absolute বা চির সত্য ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না । তিনি জীবনের মূল্য বলতে জীবনের বৃদ্ধিমূলক চাহিদা পূরণকে বুঝিয়েছেন । কোনো না কোনো বাস্তব চাহিদা পুরণের মধ্য দিয়ে তৃপ্তিদান করে , তাই হল Value বা মূল্য । এই অর্থে তিনি মূল্য সম্পর্কে একটি আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন । শিক্ষার মূল্যকে ডিউই এই একই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন ।
ডিউই জীবনকে একটি নিরত্তর বৃদ্ধিসাধনের গতিশীল প্রক্রিয়ারূপে গণ্য করলেন । তাঁর মতে , এই বৃদ্ধি কোনো উদ্দেশ্যহীন অনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া নয় । ব্যক্তির সঠিক বৃদ্ধিসাধনের জন্য আদর্শ পরিবেশ রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের উপর তিনি বিশেষ গুরুত্বদান করেছেন । নির্বাচিত সমাজ অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনই এক্ষেত্রে সঠিক নিয়ন্ত্রণ । গণতান্ত্রিক আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে । এই অর্থে নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে ব্যক্তিজীবনের বৃদ্ধি সাধনের অনুকূল সামাজিক অভিজ্ঞতা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া হল শিক্ষা । ডিউই তাই বলেছেন , শিক্ষাই জীবন , জীবনই শিক্ষা — এ দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই ।
ডিউই তাঁর এই শিক্ষা ধারণার ভিত্তিতে শিক্ষার প্রয়োগ সাধনের বিভিন্ন দিকগুলিকে বিচার করেছেন । তাঁর নির্ধারিত আদর্শকে অনুসরণ করে শিক্ষা পাঠক্রমকে একটি অভিজ্ঞতা ও সক্রিয়তা – ভিত্তিক বাস্তব রূপদানের কথা বলা হয়েছে । তত্ত্বমূলক বিষয়ের অনুশীলনের পরিবর্তে আত্মসক্রিয়তামূলক ক্রিয়াকর্ম ও সমাজ অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনই হল এই পাঠক্রমের মূলভিত্তি । এটিকে অনেকেই experience curriculum , আবার অনেকে activity cur riculum নামে অভিহিত করেছেন । আসলে এই পাঠক্রম শিশুর স্বাভাবিক নিরন্তর বৃদ্ধিসাধনের চাহিদার পরিপূরক পাঠক্রম হিসাবে সংগঠিত হয়েছে । শুধুমাত্র দৈহিক সক্রিয়তাই নয় , চিন্তনমূলক বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনের উপাদানের সমন্বয়ে ডিউই – র শিক্ষা পাঠক্রম সংগঠিত হয়েছে । লক্ষ করলে দেখা যায় যে , ডিউই পরিকল্পিত পাঠক্রমটি আসলে শিক্ষার্থীর আত্মসক্রিয়তামূলক সৃষ্টিধর্মী পাঠক্রম ।
ডিউই – র শিক্ষণ পদ্ধতি , শিক্ষক ও শৃঙ্খলা : ডিউই – র পাঠক্রমিক ধারণার সঙ্গে সমন্বিত হয়ে তাঁর শিক্ষাপদ্ধতির ধারণাটিও গড়ে উঠেছে । ডিউই শিখনে শিশুর self learning বা আত্মশিখনের উপর জোর দিয়েছেন । এই অর্থে শিশু তার আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে শিক্ষালাভ করে । শিশু নিজেই তার শিখনের উদ্দেশ্য ও বিষয়কে নির্বাচন করবে যার মধ্যে তার কোনো বৃদ্ধিমূলক চাহিদা পূরণের প্রশ্ন বা সমস্যা যুক্ত থাকে । এই সমস্যাটিকে আত্মসক্রিয়তামূলক কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে সমাধান করাই তার আত্মশিখনমূলক বৃদ্ধিসাধনের ভিত্তি গড়ে তোলে । এই সমস্যাসমাধানের প্রক্রিয়াটিই ডিউই – র মতে — শিক্ষার আদর্শ পদ্ধতিকে বুঝিয়ে থাকে । এটিই Problem solving method নামে পরিচিত । এর মধ্য থেকেই বিখ্যাত প্রোজেক্ট মেথড – এর উদ্ভব হয়েছে । ডিউই – র এই শিক্ষণ পদ্ধতি কয়েকটি স্তর বা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে কার্যকর হয়ে থাকে । এগুলি হল—
( i ) সমস্যার পরিচয় বা নির্ধারণ ;
( ii ) সমস্যার বিশ্লেষণ ;
( iii ) সমস্যার সমাধানের সম্ভাব্য পরিকল্পনা রচনা করা ;
( iv ) পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা এবং
( v ) অর্জিত অভিজ্ঞতা ও সাফল্য – ব্যর্থতা সম্পর্কে মূল্যায়ন । ডিউই তাঁর পদ্ধতিকে learning by doing অর্থাৎ হাতেকলমে কাজ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রক্রিয়াকে আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি বলেছেন । শিক্ষকের ভূমিকা নির্ধারণ করতে গিয়ে ডিউই শিশুর বৃদ্ধিমূলক বিকাশ সাধনের উপযোগী শিক্ষা পরিবেশ সংগঠন ও পদ্ধতি যাতে বাস্তবরূপ লাভ করতে পারে সে সম্পর্কে একজন পর্যবেক্ষণ ও সাহায্যদানকারী বিশেষজ্ঞরূপে বিচার করেছেন । শিক্ষায় শৃঙ্খলা সম্পর্কে ডিউই শিশুর স্বাধীন আত্মশৃঙ্খলার ধারণাটি উপস্থিত করেছেন । এটিকে আমরা মুক্ত শৃঙ্খলার ধারণা বলতে পারি । এই উদ্দেশ্যে ডিউই বিদ্যালয়কে গৃহ জীবনের অনুরূপ একটি স্বাভাবিক সংগঠন হিসাবে বিদ্যালয় জীবন সংগঠনের কথা বলেছেন ।