গ্রহরূপে পৃথিবী

📚 [ 3 ] গ্রহরূপে পৃথিবী : সূর্য থেকে দূরত্ব , ব্যাস ও ব্যাসার্ধ , আয়তন ও ওজন

🔲 সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব : পৃথিবী উপবৃত্তাকার পথে সূর্যের চারদিকে পরিক্রমা করে , তাই সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সব সময় এক থাকে না । সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্ব হল ১৪ কোটি ৯৫ লক্ষ কিলােমিটার ( বা ১৫ কোটি কি.মি. ) । দূরত্ব অনুসারে সূর্য থেকে পৃথিবী তৃতীয় গ্রহ ( বুধ ও শুক্রের পর ) ।

🔲 পৃথিবীর ব্যাস , ব্যাসার্ধ , পরিধি ও আয়তন : পৃথিবীর পূর্ব – পশ্চিমে নিরক্ষীয় ব্যাস ১২,৭৫৭ কি.মি. এবং উত্তর – দক্ষিণে মেরু ব্যাস ১২,৭১৪ কি.মি .। পৃথিবীর গড় ব্যাস ১২,৮০০ কি.মি.
এবং গড় ব্যাসার্ধ = ( ১২,৮০০ কি.মি/2 ) = ৬,৪০০ কি.মি .।
পৃথিবীর বৃহত্তম পরিধি ৪০,০৭৭ কিমি ।

📑 পৃথিবীর ভূ – পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল ৫১ কোটি ১ লক্ষ ৯৩৪ বর্গ কি.মি. এবং পৃথিবীর আয়তন হন ১,০৮৩,৩১৯,৭৮০,০০০ ঘন কিলােমিটার ।

🔘 এরাটসথেনিসের প্রমাণ : প্রায় ২,০০০ বছর এরাটসথেনিস ( Eratosthenes ) নামে এক মিশরবাসী গ্রীক পণ্ডিতনীলনদের তীরে কর্কটক্রান্তি রেখায় অবস্থিত সীন ( Syne : ২৩½° উঃ অক্ষাংশ ) ও প্রায় একই দ্রাঘিমায় অবস্থিত আলেকজান্দ্রিয়া ( ৩০½° উঃ অক্ষাংশ ) নামে দুটি নগরীর কর্কট – সংক্রান্তির দিন সূর্যরশ্মির পতন কোণের পার্থক্য বিচার করে প্রায় সঠিক ভাবে পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করেছিলেন । এরাটসথেনিসের হিসেবে পৃথিবীর পরিধি ছিল ২,৫০,০০০ স্ট্যাডিয়া বা ৪৬,২৫০ কিমি * ( ১ স্ট্যাডিয়া = ১৮৫ মিটার ) । অনুন্নত যন্ত্রাদির সাহায্যে পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করতে গিয়ে এরাটসথেনিস হয়ত কিছুটা ভুল করেছিলেন , কিন্তু মনে রাখা দরকার যে , তার আবিষ্কৃত পদ্ধতি ভবিষ্যতে পৃথিবীর পরিধি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে ।

পৃথিবীর ওজন :

🔘 এরাটসথেনিসের হিসেবে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ কত ?. এরাটসথেনিসের হিসাব অনুসারে পৃথিবীর পরিধি ছিল ৪৬,২৫০ কিলােমিটার । এখন গােলাকার পৃথিবীর পরিধি = ৪৬,২৫০ কিমি . = 2πr ( π= ২২/7 , পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ) । অথবা , ৪৬,২৫০ কিমি . = ২ x ২২/7 Xr অথবা , ৪৬,২৫০ কিমি=44×r/7 . সুতরাং , r = 46250×7/44কিমি .= ৭,৩৫৮ কিলােমিটার ( প্রায় ) ।

অতএব এরাটসথেনিসের হিসাব অনুসারে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ হল প্রায় ৭,৩৫৮ কিলােমিটার ।

🔲 পৃথিবীর ওজন : পৃথিবীর ঘনত্ব ( ৫.৫২ গ্রাম প্রতি ঘন সেন্টিমিটার ) ও অভিকর্য শক্তির ওপর ভিত্তি ওজন স্থির করা হয়েছে ৫,৯৮৮X১০¹⁸ টন বা ৫,৯৮৮,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ টন , অথবা ৬ কোটি কোটি টন ( অর্থাৎ ৬ – এর পর ২১ টি শূণ্য বসালে যে সংখ্যা পাওয়া যায় ) ।

পৃথিবীর আবর্তন ও পরিক্রমণ এবং তাদের ফলাফল :

📜 ভূমিকা : সূর্য প্রত্যেকদিন পূর্ব আকাশে উদিত হয় এবং পশ্চিম আকাশে অস্ত যায় । পৃথিবীর মানুষের তাই এককালে ধারণা ছিল যে , পৃথিবী স্থির আর সূর্য তার চারদিকে ঘুরছে । কিন্তু বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছে যে , ব্যাপারটা মােটেই ঠিক নয় । আসলে সূর্য মােটামুটি একই জায়গায় রয়েছে , ঘুরছে আমাদের পৃথিবী । কোন চলন্ত গাড়ীতে বসে বাইরে তাকালে যেমন মনে হয় গাছপালা সব পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে , তেমনি আমরাও চলন্ত পৃথিবী থেকে সূর্যকেও অমনি উদিত হতে এবং অস্ত যেতে দেখি ।

🔲 পৃথিবীর গতি : গাড়ির চলা ও পৃথিবীর ঘােরার মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে । গাড়ি একদিক থেকে অন্যদিকে চলে ; পৃথিবীও একদিক থেকে অন্যদিকে ছােটে , তবে সে নিজের মেরুদণ্ডের ওপর পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে ঘুরতে ঘুরতে তবে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে । এই ঘােরাটা অনেকটা লাটিমের নিজের আলের ওপর ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে যাওয়ার মতন । তবে লাটিমের ঘােরার কোন নির্দিষ্ট পথ নেই , কিন্তু পৃথিবী নিজের মেরুদণ্ডের ওপর ঘুরতে ঘুরতে একটি নির্দিষ্ট পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ।

🔘 অতএব দেখা যাচ্ছে যে , পৃথিবীর দু’রকমের গতি রয়েছে , যেমন :

( ক ) তার নিজের মেরুদণ্ডের বা অক্ষের ( Axis ) চারদিকে ঘােরার গতি , যার নাম আবর্তন গতি বা আহ্নিক গতি ( Rotation ) এবং

( খ ) তার সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করার গতি , যাকে বলে পরিক্রমণ গতি ( Revoluation ) বা বার্ষিক গতি ( Annual Motion ) ।

📚 [ ক ] পৃথিবীর আবর্তন গতি বা আহ্নিক গতি :

🔘 পৃথিবীর আবর্তন গতি বা আহ্নিক গতি : পৃথিবীর তার নিজের মেরুদণ্ডের বা অক্ষের চারদিকে একদিনে একবার নির্দিষ্ট গতিতে পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তন করে । পৃথিবীর এই গতিকে দৈনিক গতি বা আবর্তন গতি বা আহ্নিক গতি বলে ।

📑 পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে পৃথিবীতে দিন – রাত্রি , জোয়ার ভাটা সৃষ্টি , বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্র স্রোতের গতিবিক্ষেপ এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয় । পৃথিবী একটি অভিগত গােলক হওয়ায় পৃথিবী পৃষ্ঠের পরিধি সর্বত্র সমান নয় । ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠের সমস্ত স্থানের আবর্তনের বেগও সমান হয় না , যেমন : নিরক্ষরেখায় আবর্তন গতির বেগ সবচেয়ে বেশী । আবর্তনের বেগ নিরক্ষরেখার উত্তর ও দক্ষিণে কমতে কমতে দুই মেরুবিন্দুতে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায় ।

🔘 পৃথিবীর আবর্তন গতিকে আহ্নিক গতিও বলা হয় কেন ? ‘ অহ্ন ’ থেকে আহ্নিক শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে । “ অহ্ন ’ শব্দটির অর্থ হল দিন । নিজের মেরুরেখার চারদিকে একবার সম্পূর্ণ ঘুরতে বা আবর্তন করতে পৃথিবীর সময় লাগে প্রায় ২৪ ঘন্টা বা ১ দিন । পৃথিবীর একবার আবর্তনের সময়কে ১ দিন বা ১ অহ্ন ধরা হয় , তাই আবর্তন গতিকে ( Rotation ) আহ্নিক গতিও ( Diurnal Motion ) বলা হয় ; অর্থাৎ , পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে দিন রাত্রি হয় বলে আবর্তন গতিকে আহ্নিক গতি বলে ।

🔘 নিজের মেরুদণ্ডের ওপর একবার ঘুরতে পৃথিবীর কত সময় লাগে ? পৃথিবীর নিজের মেরুদণ্ডের ওপর একবার পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্ন করতে সময় লাগে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট বা মােটামুটি ২৪ ঘণ্টা বা একদিন , একে সৌর দিন বলে ।

📚 [ খ ] সূর্যের আপাত দৈনিক গতি :

🔘 পৃথিবীর সব স্থানে আহ্নিক গতির বেগ একরকম হয় না কেন ?

পৃথিবী একটি অভিগত গােলক বলে পৃথিবীপৃষ্ঠের পরিধি সর্বত্র সমান নয় । ফলে , পৃথিবীপৃষ্ঠের সমস্ত স্থানের আবর্তনের বেগও সমান হয় না । নিরক্ষরেখায় পৃথিবীর পরিধি সবচেয়ে বেশী ( প্রায় ৪০,০০০ কি.মি. ) । এইজন্য নিরক্ষরেখায় পৃথিবীর আবর্তনের বেগ সবচেয়ে বেশী , ঘণ্টায় প্রায় ১,৭০০ কি.মি .। নিরক্ষরেখা থেকে যতই উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর দিকে যাওয়া যায় , পৃথিবীর আবর্তনের বেগ ততই কমতে থাকে । কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখায় ( ২৩ ½° উঃ ও ২৩½° দঃ অক্ষাংশ ) পৃথিবীর আবর্তনের বেগ ঘন্টায় প্রায় ১৫২০ কিলােমিটার । কলকাতায় পৃথিবীর আহ্নিক গতির বেগ ঘণ্টায় । প্রায় ১,৫৩৬ কিলােমিটার । আবর্তনের বেগ নিরক্ষরেখার উত্তরে ও দক্ষিণে কমতে কমতে দুই মেরুবিন্দুতে ( ৯০ ° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশে ) প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায় ।

🔘 আমরা পৃথিবীর আবর্তন গতি বুঝতে পারিনা কেন ? এবং পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে আমরা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ছিটকে পড়ি না কেন ?

আমরা যদি নিরক্ষরেখায় দাড়াই তবে আমরা পৃথিবীর সাথে সাথে ঘন্টায় প্রায় ১৭০০ কি.মি. বেগে ঘুরতে থাকবাে । আবার সুমেরু অথবা কুমেরু বিন্দুতে দাঁড়ালে কোন রকম না ঘুরেও ২৪ ঘন্টা পার করে দেবাে । তবে ভূপৃষ্ঠে বসবাস করা সত্ত্বেও আমরা পৃথিবীর আবর্তনগতি বুঝতে পারি না । এর কারণ হল : আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠের যেখানে আছি তার পারিপার্শ্বিক গাছপালা , জীবজন্তু , যাবতীয় জিনিসপত্র প্রভৃতি পৃথিবীর সঙ্গে একই গতিতে এবং একই সঙ্গে আবর্তন করে , অর্থাৎ প্রতিটি সচলবস্তুর আপেক্ষিক অবস্থান একই থাকে , আমাদের চোখে তার স্থানগত পরিবর্তন ঘটে না , ফলে আমরা পৃথিবীর আবর্তন গতি অনুভব করতে পারি না । অন্যদিকে ভূ – পৃষ্ঠে অবস্থিত সমস্ত বস্তুকে পৃথিবী অভিকর্ষ শক্তির বলে নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে , এজন্য আমরা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ছিটকে পড়ি না ।

🔘 সূর্যের আপাত দৈনিক গতি কাকে বলে ?

আহ্নিক গতির সময় পৃথিবী পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করে বলে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আপাতদৃষ্টিতে সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে গতিশীল বলে মনে হয় , তাই আহ্নিক গতিকে সূর্যের আপাত দৈনিক গতি–ও বলে ।