অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা কাকে বলে ? অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য লিখুন । প্রথাগত বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যলাভের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষকের ভূমিকা লিখুন ।
উত্তর :- ‘ অন্তর্ভূক্তি ‘ কথাটি শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ধারণা দেয় তার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয় কঠিন । Norwich ( 1999 ) অন্তর্ভুক্তি ( Inclusive ) কথাটির ব্যাখ্যা করেছেন কোনোভাবে শিশুদের মধ্যে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকে , অথচ অন্যান্য দিক থেকে তারা সং স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের মতোই , তাদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া ও তাদের ব্যক্তিগত চাহিল অনুসারে শিখনের সুযোগ দেওয়াই হল ‘ অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ‘ । ‘
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ‘ এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি গোষ্ঠীর ( Community ) সব শিশু একত্রে স্থানীয় স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় , এমনকি সেই শিশুদের কেউ কেউ যদি মানসিক বা শারীরিক বা অন্য কারণে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন হয় ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য :
(1) এই শিক্ষা বিদ্যালয়গুলির উন্নয়নের কথা বলে যাতে শিশুরা কার্যকরীভাবে শিক্ষালাভ করে ও অকৃতকার্য শিশুর সংখ্যা কমে যায় ।
(2 ) এখানে বিদ্যালয় ও শিক্ষকগণ মেনে নেন যে , প্রতিটি শিশুর ব্যক্তিসত্তা পৃথক কাজেই স্কুলকে সবার চাহিদা পূরণের জন্য নমনীয় হতে হবে ।
(3 ) শিক্ষকদের শিখতে হয় প্রতিটি শিশুর সমস্যার কীভাবে সমাধান করতে এগিয়ে আসতে হবে ।
( 4 ) প্রতিবন্ধী শিশুরা বিদ্যালয়ে তাদের প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে পড়ার সুযোগ পায়
( 5 ) অভিভাবকগণ তাদের প্রতিবন্ধী শিশুদের পঠন – পাঠনের জন্য বিদ্যালয়ের সহযোগিতা লাভ করেন ।
( 6 ) এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অধিকারকে নিশ্চিত করেছে । প্রথাগত বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যলাভের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলি হল–
( 1 ) সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষণ দক্ষতাবৃদ্ধি :–
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার সার্থক রূপায়ণের জন্য সাধারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন হয় বিশেষ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকগণ একাজে সাধারণ শিক্ষকদের সাহায্য করবেন । যেসব শিক্ষক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয় তাদের জন্য বছরে 5-10 দিনের শিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে ।
( 2 ) চাহিদাভিত্তিক নির্দেশনামূলক কৌশল অবলম্বন :–
সব শিশুর চাহিদা এক রকম তাদের প্রতিবন্ধকতাও এক ধরনের নয় । এদের অনেকে সর্বদা সাহায্য প্রত্যাশী আবার অনেকে সামান্য সাহায্য পেলেই এগিয়ে যেতে পারে । এইজন্য প্রয়োজনভিত্তিক সাহায্য ও শিক্ষাদান কৌশল অবলম্বন করতে হয় । প্রকৃত প্রয়োজন বুঝে শিক্ষাদান ও সাহায্য করা এই শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যের উপায় ।
( 3 ) বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের আদানপ্রদানঃ–
জেলা পুনর্বাসন কেন্দ্র , সমন্বিত শিশুবিকাশ প্রকল্পের কর্মী , স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র , বিশেষ স্কুল , ব্রেইল সংক্রান্ত সংস্থাগুলি প্রত্যেককে এই শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা ও যোগাযোগের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে ।
( 4 ) অভিভাবক ও সমাজের অন্যান্যদের অংশগ্রহণ :–
এই শিক্ষা কার্যক্রমে অভিভাবকদের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন । এর ফলে অন্তর্ভুক্তির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটে ।
( 5 ) বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ও সাধারণ শিশুর মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন ও সহযোগিতামূলক শিখন : –
সাধারণ শিশুরাও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষালাভের ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করতে পারে ।
(6 ) নমনীয় পাঠক্রম এবং সহপাঠক্রমের ব্যবস্থা : —
যদিও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল সকলের জন্য যতদূর সম্ভব একই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা করা । তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ পাঠক্রম ও সহপাঠক্রমের প্রয়োজন হয় । যেমন — ভাষা শিক্ষার জন্য শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের বিশেষ পাঠক্রম প্রয়োজন হতে পারে । আবার ভূগোলে মানচিত্র অঙ্কন বা রেখাচিত্র অঙ্কনের জন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে ।
( 7 ) Peer Tutoring- এর ব্যবস্থা করা : —
এক্ষেত্রে দুজন , তিনজন বা চারজন শিক্ষার্থী এক সঙ্গে কাজ করে । Peer Tutoring- এর ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সাহায্য ও মত আদানপ্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আবশ্যিক পরিসেবা ও শিক্ষকের ভূমিকা : —
এই শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যালয়গুলিতে যেসব আবশ্যিক পরিসেবাগুলির ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন হয় , সেগুলি হল—
( 1 ) প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নির্দেশনার কৌশলের পরিকল্পনা করা ।
( 2 ) কী কী বিষয় শিক্ষাদান করা হবে তা নির্ধারণ করা ।
( 3 ) পাঠ্যক্রমিক ও সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের উপস্থিতির হারের হিসাব রাখা ।
( 4 ) ক্লাসে শৃঙ্খলারক্ষার ব্যবস্থা করা ।
( 5 ) গৃহকাজ দেখে সংশোধন করে দেওয়া ।
( 6 ) মূল্যায়ন ব্যবস্থা পরিচালনা করা ।
( 7 ) শিশুদের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা ।
( 8 ) শিশুদের অগ্রগতি পরিমাপ করা ।
( 9 ) বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিশুদের পাঠক্রম ও চাহিদা বিষয়ে আলোচনা করা ।
( 10 ) অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা । এই আবশ্যিক পরিসেবাগুলি ছাড়াও কতকগুলি সহায়ক পরিসেবা ( Support Service দেওয়ার প্রয়োজন হয় । এই পরিসেবা দিয়ে থাকে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ । এঁরা প্রতিবন্ধী শিশুদের পঠন – পাঠন দিকটি যেমন দেখেন তেমনি নানা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে সাহায্য করেন যা শিশুদের শিখনের সহায়ক । তাঁরা শ্রেণির সাধারণ শিক্ষকদের পরামর্শ দেন ।
এই সহায়ক পরিসেবাগুলি হল—
( 1 ) প্রতিবন্ধী বা অন্যভাবে পিছিয়ে থাকা শিশুদের খুঁজে বের করা । কীভাবে প্রতিবন্ধীদের পড়াতে হবে সে বিষয়ে উপযুক্ত পরামর্শ দান ।
(2) কি কি বিষয় শিক্ষাদান করা হবে তা নির্ধারণ করা
(3 ) সাধারণ শ্রেণি – শিক্ষকদের প্রয়োজনমতো তাঁদের কাজে সাহায্য করা ।
(4) প্রতিবন্ধী শিশুদের পরীক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করা ।
( 5 ) শিখন – সামগ্রীর ব্যবস্থা করা ।
( 6 ) শিখন সহায়ক উপকরণ ও যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা ।
( 7 ) শ্রেণি – শিক্ষকদের মাধ্যমে শিশুদের অগ্রগতি লক্ষ করা । এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কিছু এককালীন সাহায্য করার দরকার হয় । হাসপাতাল , পুনর্বাসন কেন্দ্র বা NGO- গুলি এই ধরনের সাহায্য করে থাকে । তারা যেসব কাজ করে সেগুলি হল—
1 ) চিকিৎসা – সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রদান করা ।
( 2 ) সামাজিক সাহায্যের বন্দোবস্ত করা ।
( 3 ) প্রতিবন্ধী – সংক্রান্ত শংসাপত্র প্রদান ।
( 4 ) অভিভাবকদের কাউন্সেলিং – এর ব্যবস্থা করা ।