প্রশ্ন : অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার ধারণা দিন । ভারতবর্ষে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার ঐতিহাসিক পটভূমি লিখুন ।
উত্তর : অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার ধারণা : ‘অন্তর্ভূক্তি’ কথাটি শিক্ষার ক্ষেত্রে যে ধারণা দেয় তার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন । Norwich (1999) অন্তর্ভুক্তি (Inclusive) কথাটির ব্যাখ্যা করেছেন—যদি কোনোভাবে শিশুদের মধ্যে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকে , অথচ অন্যান্য দিক থেকে তারা সব স্বাভাবিক মতোই , তাদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া ও তাদের ব্যক্তিগত চাহিদা অনুসারে শিখনের সুযোগ দেওয়াই হল ‘ অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ‘ । খুব সহজ ভাষায় বলা যায় ‘ অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ‘ হল এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একটি গোষ্ঠীর (Community) সব শিশু একত্রে স্থানীয় স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় , এমনকী সেই শিশুদের কেউ কেউ যদি মানসিক বা শারীরিক বা অন্য কারণে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন হয় ।
ঐতিহাসিক পটভূমি : অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা একটি আধুনিক ধারণা । তবে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার সূচনা হয়েছে অর্থাৎ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা তা ভারতবর্ষে নতুন নয় । ভারতীয় সংবিধানের 845 নং ধারায় 6-14 বছরের সমস্ত শিশুর জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে , যেখানে সমন্বিত শিক্ষার ধারণাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । 1960 খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় সরকারের সমাজসেবা মন্ত্রক (Ministry of Social Welfare) সমাজের দুর্বল অংশের উন্নয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং যেসব স্বেচ্ছাসেবক এবং বেসরকারি সংস্থা সমাজের এই দুর্বল অংশের উন্নয়নে আগ্রহী তাদের সাহায্য এবং অনুপ্রাণিত করেছিল । 1971 খ্রিস্টাব্দে পরিকল্পনা কমিশন সমন্বিত শিক্ষা কর্মসূচিকে প্রোজেক্ট হিসেবে গ্রহণ করে । এরপর 1974 খ্রিস্টাব্দে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য Integrated Child Development Scheme (ICDS) নামে সমন্বিত শিক্ষার যে কর্মসূচি গৃহীত হয় তা বর্তমানেও চালু আছে ।
ভারতে প্রতিবন্ধী শিশুদের মূল স্রোতের শিক্ষার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি বিশেষ । প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ বিদ্যালয় স্থাপন করে । 1983 খ্রিস্টাব্দে Bombay-তে প্রথম বধিরদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ।
1986 খ্রিস্টাব্দের জাতীয় শিক্ষানীতিতে সুপারিশ করা হয় যে , শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের সাধারণ জনসাধারণের সঙ্গে সমানভাবে সমন্বয়িতকরণ , তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করা , সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের জীবন উপভোগ করার সুযোগ করে দিতে হবে । এই সুপারিশটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার ইঙ্গিত বহন করে ।
1992 খ্রিস্টাব্দের POA-তে বলা হয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মূল স্রোতে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ সুযোগসুবিধা , অধিকার দান এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করতে হবে । 1992 খ্রিস্টাব্দেই RCI আইন (Rehabilitation Council of India Act) সংসদে গৃহীত হয় ।
1994 খ্রিস্টাব্দে স্পেনের সালমানকায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যে প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয় । ভারতবর্ষ যেখানে স্বাক্ষর করে । সালমানকায় সম্মেলনে আরও অনুরোধ করা হয় যে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাকে জাতীয় শিক্ষানীতির অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে ।
2000 খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত EI গোষ্ঠীর দেশগুলির সম্মেলনে সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থার (EFL) উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় যেখানে বলা হয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ।
2005 খ্রিস্টাব্দে প্রতিবন্ধী শিশু ও যুবকদের অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার জন্য IECXD (Inclusion of children and youth with disability) প্রকল্প গ্রহণ করা হয় । 2006 খ্রিস্টাব্দে সর্বশিক্ষা অভিযানে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাকে যুক্ত করা হয় ।
সবশেষ 2009 খ্রিস্টাব্দের RTE (Right to Education) Act এ অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার কথা উল্লেখ করা হয় ।
প্রশ্ন : অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা এবং সমন্বয়সাধন বলতে কী বোঝায় ? অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা লিখুন ।
উত্তর : ‘সমন্বয়ন’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিকরণ’ —এই দুটি শব্দের অর্থ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে । অবশ্য এই দুই শব্দের দ্বারাই প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তি করার কথা বোঝানো হয় । যদিও মতাদর্শগত এবং দার্শনিক ভিত্তির দিক থেকে এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান ।
সমন্বয়নের দ্বারা প্রতিবন্ধী শিশুকে একীভূত শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার কথা বলা হয় । এর জন্য সেই শিশুকে সাধারণ বিদ্যালয়ের উপযোগী কিছু প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং এই শিশুর পাশাপাশি তার অভিভাবককেও এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন করার চেষ্টা করা হয় । অপরদিকে অন্তর্ভুক্তিকরণের দ্বারা প্রতিবন্ধী শিশুকে অন্য সাধারণ শিশুদের মতো সরাসরি বিদ্যালয়ে ভরতি করা বোঝানো হয় । এই আদর্শ অনুসারে প্রতিবন্ধী শিশুদের সমস্ত চাহিদা সাধারণ বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর মধ্যেই পরিপূরণ করার চেষ্টা করা হয় । সাধারণ শিশুদের সমকক্ষ করে তোলার জন্য এখানে প্রতিবন্ধী শিশুদেরও অল্প বয়সে বিদ্যালয়ে ভরতি করার কথা বলা হয় । এখানেই সমন্বয়নের সঙ্গে তার পার্থক্য । কারণ অন্তর্ভুক্তিকরণের অর্থই হল সমগ্র শিক্ষা পরিকল্পনার সঙ্গে একাত্মীকরণ যার মধ্যে থাকবে বিদ্যালয় গৃহ , আসবাবপত্র , শিক্ষা – সহায়ক উপকরণ , শিক্ষক , বিদ্যালয় পরিচালক এবং প্রতিবন্ধী শিশুর চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিশেষ ব্যবস্থা ও পাঠক্রম ইত্যাদি । এক্ষেত্রে প্রয়োজনে পাঠক্রম সংশোধন করতে হয় । অর্থাৎ তাদের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে পাঠ্যপুস্তক , শিক্ষণ পদ্ধতি , কর্মকৌশল এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি সংশোধন করতে হয় ।
অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে যে-কোনো মানসিকতা সংক্রান্ত বাধা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় বন্ধনমুক্ত পরিবেশ এবং ন্যূনতম নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হয় । সবশেষে বলা যায় , সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সাধারণ ও প্রতিবন্ধী শিশু—উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষক , বিশেষ শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়ে থাকে ।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা : অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিদ্যাল প্রশাসনের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে । মূলত এই ধরনের শিক্ষার বাস্তবায়নের উপযুক্ত পরিে রচনা করে বিদ্যালয় প্রশাসন । সাধারণ বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতি শিক্ষার্থীদের একত্রে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সকল বাধা অতিক্রম দ্বায়িত্ব বিদ্যালয় প্রশাস প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকাগুলি হল—
(ক) অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক অনুদান সরকার বা স্থানীয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জোগাড় করা ।
(খ) প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা ।
(গ) বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকদের স্বল্পকালীন বিশেষ শিক্ষার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ।
(ঘ) বিদ্যালয়ের শিক্ষক – শিক্ষিকাদের নিয়ে এই শিক্ষা বিষয়ে পর্যালোচনা করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও গুরুত্ব তুলে ধরা ।
(ঙ) বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের ভিতরে ও বাইরে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোগত উন্নতির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া ।
(চ) শিক্ষকদের শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের জোগান দেওয়া ।
(ছ) প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে পাঠ্যক্রমের প্রয়োজনীয় সংযোজন ও বিয়োজন করা ।
(জ) বিদ্যালয়ের সমস্ত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতিবন্ধিতার ধরন ও মাত্রা নির্ধারণের জন্য উপযুক্ত চেক্ – আপ ক্যাম্পের আয়োজন করা ।
(ঝ) শিক্ষক – শিক্ষিকা , অভিভাবক ও অভিভাবিকাদের নিয়ে মাঝে মাঝে সাধারণ সভার অয়োজন করা ।
(ঞ) প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ও তাদের অভিভাবকদের শিক্ষা বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা ।