প্রশ্ন ৪ ) হান্টার কমিশন গঠনের কারণ কী ছিল ? এই কমিশনের উদ্দেশ্য কী ছিল ?
উত্তর : যে-কোনো শিক্ষা কমিশন গঠনের পশ্চাতে কিছু কারণ থাকে । হান্টার কমিশন গঠনের কারণগুলি হল—
(1) 1854 খ্রিস্টাব্দের পর সরকারি অবহেলার ফলে গণশিক্ষার প্রসার ব্যাহত হয় । প্রশাসনিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ে ।
(2) সরকারের অবহেলা ও স্থানীয় জনগণের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশজ শিক্ষাব্যবস্থ দ্রুত ক্ষয় হয় ।
(3) প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতার অভাব ।
(4) ডেসপ্যাচের নির্দেশিকার দরুন শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি প্রচেষ্টাকে কোনোভাবে সাহায্য করা হয় না । যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষা ভীষণভাবে ব্যাহত হয় ।
(5) শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ হ্রাস করার কোনো সদিচ্ছাই দেখা যায় না ।
(6) এই সময়ে ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয় চেতনা খুব তীব্র আকার ধারণ করে । তাঁরা পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিবর্তে ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা দাবি করেন ।
(7) শিক্ষার ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য সংক্রান্ত ডেসপ্যাচের নির্দেশিকা যথাযথভাবে না মানা বেসরকারি উদ্যোগকে আর্থিক সাহায্যের অভাব , অপর দিকে নিত্যনতুন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ইত্যাদি সাধারণ জনসাধারণের নিকট এক সংকেত পাঠায় যে , সরকার সুকৌশলে বেসরকারি প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করতে চাইছে ।
(8) মিশনারিদের মধ্যেও অসন্তোষ দানা বাঁধে । ডেসপ্যাচের পর তাঁরা ভেবেছিলেন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় তাঁরাই মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করবেন । তা না হওয়ায় তাঁদের মধ্যে হতাশা দেখা যায় । ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করে তাঁরা একে ‘ঈশ্বরবিহীন এবং অধর্মীয়’ শিক্ষা বলতে থাকেন (Godless and Irreligious) সরকারি শিক্ষা বিভাগের বিমাতৃসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে তাঁরা একে আন্দোলন শুরু করেন । তাঁরা ইংল্যান্ডেও এর বিরুদ্ধে প্রচার চালান এবং 1878 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ‘General Council of Education in India’ নামে একটি সংস্থা স্থাপন করেন । মিশনারিরা তদানীন্তন ভারত সচিব লর্ড হাটিংটনের নিকট একটি ডেপুটেশন দেন এবং আগামী দিনে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপনের নিকট তাঁদের অসন্তোষ ব্যস্ত করেন ।
কাউন্সিল গঠন: 1882 খ্রিস্টাব্দে 3 ফেব্রুয়ারি লর্ড রিপন একটি কমিশন গঠন করেন । এটিই ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশন যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্যার হান্টার নামে এক ইংরেজ । তিনি ছিলেন গভর্নর জেনারেলের অছি পরিষদের একজন মাননীয় সদস্য । চেয়ারম্যানের নাম অনুসারে এই কমিশন হান্টার কমিশন নামে খ্যাত ।
কমিটির ভারতীয় সদস্যদের মধ্যে ছিলেন —মিস্টার হজ গুলাম , শ্রী আনন্দমোহন বসু , শ্রী পি আর মুদালিয়র , বাবু ভূদেব মুখার্জি প্রমুখ । মহীশূরের সেই সময়কার ডি পি আই মিস্টার এল রাইস ছিলেন কমিশনের সচিব ।
কমিশিনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : কমিশনের মূল উদ্দেশ্য এবং পর্যালোচনার দিকগুলি ছিল— (1)1854 খ্রিস্টাব্দের ডেসপ্যাচের নীতিগুলি কী পরিমাণে কার্যকারী হয়েছে এবং নীতিগুলিকে আরও কার্যকারী করে তুলতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয় ।
(2) জনশিক্ষার প্রবল চাহিদার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে অনুসন্ধান করা ।
(3) আর্থিক অনুদান আরও প্রসারিত করতে প্রয়োজনীয় নীতি ও কৌশল স্থির করা ।
(4) প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগের কার্যকারিতা সম্পর্কে অনুসন্ধান ।
(5) জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ।
(6) ধর্মীয় শিক্ষা সম্পর্কে সরকারের নীতি স্থির করা , ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিশিক্ষা এবং ইউরোপীয়দের শিক্ষা কমিশনের এক্তিয়ারে ছিল না ।
দীর্ঘ ৪ মাস ব্যাপী সারা ভারতবর্ষে কমিশন ভ্রমণ করেন । 1883 খ্রিস্টাব্দে 220 টি নীতি সমেত 800 পৃষ্ঠার রিপোর্ট পেশ করেন ।
প্রশ্ন 9 : বুনিয়াদি শিক্ষা-পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যর্থতার কারণগুলি লিখুন ।
উত্তর : বুনিয়াদি শিক্ষা-পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা
• ভারতবর্ষের মতো দেশের পক্ষে এই ধরনের শিক্ষা-পরিকল্পনা খুবই প্রয়োজনীয় । দেশে সর্বজনীন বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার জন্যও এই পরিকল্পনা Zakir Hussain Committee- র মতে “We consider the scheme of basic education to be sound in itself . It should be accepted as a matter of sound educational policy and as an urgent measure of national reconstruction .” অর্থাৎ বুনিয়াদ শিক্ষা স্বয়ং শক্তিশালী পরিকল্পনা জাতির পুর্ণগঠনে অত্যন্ত জরুরী এবং শক্তিশালী শিক্ষানীতির ভিত্তিতে এটি গঠিত ।
• অর্থনৈতিক দিক থেকেও এটি কার্যকারী । কারণ এটি আর্থিক স্বনির্ভরতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত । তা ছাড়া এই শিক্ষা-পরিকল্পনা জাতীয় অর্থনীতির পুনর্গঠনে সহায়তা করে ।
• এই ধরনের শিক্ষা গণতান্ত্রিক ও সামাজিক । এখানে শ্রেণিভেদ ও জাতিভেদ প্রথা নেই । তাই এটি জাতীয় সংহতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।
• এটি শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিভেদ দূরীকরণে সহায়তা করে । শুধু তাই নয , এটি কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে বৌদ্ধিক কাজের দূরত্ব দূর করে এবং ধনী-দরিদ্র ও গ্ৰাম শহরের দূরত্ব দূর করে ।
• এই শিক্ষা-পরিকল্পনা সক্রিয়তাভিত্তিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত যা সম্পূর্ণভাবে আধুনিক ও মনোবিজ্ঞানসম্মত ।
• বুনিয়াদি শিক্ষা বিদ্যালয় এবং সমাজের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে সহায়তা করে ।
• এটি সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ।
• এটি আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে । বুনিয়াদি শিক্ষা-পরিকল্পনা শিক্ষার্থীর সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।
• এটি শিক্ষা-পরিকল্পনা সূজনাত্মক এবং শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।
• এটি নাগরিকতার শিক্ষা দেয় । শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ করে তোলে ।
বুনিয়াদি শিক্ষার ত্রুটি : বুনিয়াদি শিক্ষার একাধিক উপযোগিতা থাকা সত্ত্বেও তা সার্থক হতে পারেনি , কারণ এই শিক্ষাকে সঠিকভাবে রূপায়ণের চেষ্টা করা হয়নি । বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনার ব্যর্থতার একাধিক কারণ রয়েছে । যেমন—
• এই শিক্ষার রূপায়ণে শিক্ষক , সামাজিক নেতা এবং শিক্ষা প্রশাসক সকলেরই উদাসীনতা দেখতে পাওয়া যায় এবং আরও মনে করা হয় যে , এই ধরনের উপায়ের যন্ত্র হয়ে উঠবে এবং শিক্ষাক্ষেত্র সম্পূর্ণভাবে অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠবে । পরিকল্পনা বিদ্যালয়কে ক্ষুদ্র শিল্পের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে দেবে । শিক্ষার্থীরাও অন আবার অনেক সময় দেখা যায় শিল্পটিও ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়নি ।
• এই শিক্ষা-পরিকল্পনায় Liberal Education- কে একেবারে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি । আবার অনেক সময় দেখা যায় শিল্পটিও ঠিকভাবে নির্বাচিত হয়নি ।
• এই শিক্ষা-পরিকল্পনা কখনোই জাতীয় শিক্ষা-পরিকল্পনার অংশ হয়ে উঠতে পারেনি , কারণ সমাজের মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ এই শিক্ষা পরিকল্পনাকে নিম্নমানের বলে মনে করত ।
• কিছু মানুষ মনে করত সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি ও দ্রুত শিল্পায়নের জন্য সমাজের আধুনিকীকরণ ও দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন । বুনিয়াদি শিক্ষা-পরিকল্পনা সেই প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয় । এর জন্য প্রয়োজন আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ ।
এই শিক্ষা-পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য অর্থেরও যথেষ্ট অভাব ছিল ।
• এখানে যে শিল্প শিক্ষার কথা বলা হয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণভাবে যান্ত্রিক , এর পেছনে কোনো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ছিল না । তা ছাড়া এই ধরনের শিক্ষা পরিকল্পনার সময়- তালিকা নির্মাণ করাও খুব কঠিন ।
• এই ক্ষেত্রে শিক্ষাদানের জন্য যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকেরও যথেষ্ট অভাব ছিল ।