ভূতের গল্প :চক্রান্ত

রাজচন্দ্রপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ রায়বাহাদুর রুদ্রাদিত্য দেবরাজ রায়চৌধুরী। তার তিন পুত্র। উদিত ভানু। মুদিত কমল। তৃষিত চাতক। তামাম জমিদারি রাজ, কি ছিলনা তাদের, বিঘের পর বিঘে জমি, বাগান, পুকুর, দুর্গা মন্দির এমনকি বাড়ির লাগোয়া বাঈজী ঘরও ছিলো। পালা করে সন্ধ্যের পর ডান হাতে জুঁই ফুলের মালা ঝুলিয়ে সারারাত বাঈজী নাচ দেখতে যাওয়া ছিলো সে বাড়ির পুরুষ দের পরম্পরা। লখনৌ থেকে বংশানুক্রমিক বাঈজীরা রায়চৌধুরী বাড়িতে আসতো বহুকাল ধরে। বিবাহিত হওয়া সত্বেও সুন্দরী বাঈজী দের সাথে রাত্রিযাপন বাড়ির পুরুষ দের নিত্য অভ্যেশ ছিলো। যৌবনে এমনি এক অতি সুন্দরী বাঈজীর প্রেমে পড়েন বাড়ির বড় ছেলে উদিত ভানু রায়চৌধুরী!

ওই বাঈজীর প্রেমে উন্মাদ হয়ে তিনি দিনের পর দিন তার স্ত্রী এবং সন্তানদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন আর জমিদারির অংশ সাহেব দের বিক্রি করে রায়চৌধুরী বাড়ির মানইজ্জতকে খুইয়ে ফেলার দিকে অগ্রসর হন। এহেন অবস্থায় রুদ্রাদিত্য দেবরাজ জমিদারি সম্মান রক্ষার্থে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং ওই বাঈজী রাজিউন্নীশা কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। বাড়ির বাকি সদস্যের আপত্তি সত্বেও অগ্নিসম রাগের অধিকারি রুদ্রাদিত্যের কথাই জমিদার বাড়ির শেষ কথা বলে বিবেচিত হয়!

এক শীতের রাত্রে হ্যাজাকের সোনালী আলোয় আলোকিত বাঈজী ঘরের মধ্যে রাজিউন্নীশার সাথে ঘনিষ্ট অবস্থায় সুরা পানে মত্ত ছিলেন উদিত ভানু রায়চৌধুরী, ঠিক তখনি রায়বাহাদুরের আদেশে তাদের দুজনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন তার আপন দুই ভাই মুদিত কমল এবং তৃষিত চাতক। সৎকার পর্যন্ত করা হয়না তাদের মৃতদেহ। ফেলে দেওয়া হয় নদীর জলে। সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বাঈজী ঘরটি। সমস্ত তবলচি, গাইয়ে এবং আরো অন্য বাঈজী দের ফেরত পাঠানো হয় লখনৌতে। চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় জমিদার বাড়ির বাঈজী প্রথা!

এর ঠিক এক মাস পর থেকে জমিদার বাড়িতে শুরু হয় নানা ভৌতিক উপদ্রব। রাত্রি নামলেই পোড়া বাঈজী ঘরের ভেতর থেকে শোনা যায় নূপুরের শব্দ। বাদ্যের ঝঙ্কার। সবার আগে মহাষ্টমীর রাতে সন্ধিপুজোর সময় নিজ মন্দিরে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে প্রাণ হারান রায়বাহাদুর রুদ্রাদিত্য।কিছুদিন পর নিজেদের পুকুরে ডুবে প্রাণ যায় মেজো ছেলে মুদিত কমলের। ছোটো ছেলের মৃত্যু হয় অজানা কারণে। দুই বৌমা এবং ছয় নাতি নাতনি একসাথে পুড়ে মরে বাড়ির অন্দরমহলে! এক বছরের ব্যবধানে জমিদার বংশ নির্মূল হয়, পড়ে থাকে শুধু সুবিশাল প্রাসাদপম রায়চৌধুরী বাড়ি আর বিপুল সম্পত্তি!

শোনা যায় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ঘটা এই মর্মান্তিক ঘটনাটি তৎকালীন ইংরেজ দের একটা চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। চিরকালের স্বাধীনচেতা এবং প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন রুদ্রাদিত্য দেবরাজ যিনি কোনোদিন মাথা নত করেননি সাহেব দের সামনে। বড় ছেলে বাঈজীর প্রেমে মত্ত হয়ে ইংরেজ দের সাথে মিলে পুরো বংশকে হত্যা করার চক্রান্ত করে এবং জমিদারি ভিটে মাটি মোটা টাকায় বিক্রি করে রাজিউন্নিশার সাথে অন্যত্র পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে কিন্তু সুশাসক এবং বিচক্ষণ রায়বাহাদুর সেটা আগেই টের পান তাই ওদের দুজনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার ব্যাবস্থা করেন। ঘটনাটির পরবর্তী সময়টাকে ভৌতিক পটভূমিকায় রূপান্তর করে অত্যন্ত নিপুণ ভাবে একে একে সবাইকে হত্যা করে ইংরেজরা!

যেখানে ইংরেজ দের হাতে বড় ছেলে এবং তার প্রেমিকার মৃত্যু হবার কথা ছিলো সবার শেষে, সেখানে রুদ্রাদিত্যের বিচক্ষণতা তাদের অনেক আগে শেষ করে দিলেও নিজের বংশ এবং বাকি পরিবারের শেষরক্ষা তিনি কিছুতেই আর করতে পারেন নি!!!!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page