জগদীশের বাড়িতে প্রায় শনিবার সন্ধ্যেবেলায় আমাদের এক আড্ডা বসে । আমরা এর নাম দিয়েছি ‘শনিচক্র ‘। তিন – চারজন বন্ধু জমায়েত হই সন্ধ্যেবেলায় । চা , মুড়ি , তেলেভাজা খাই আর নিছক গল্প করি । সে সব গল্পের কোনও ঠিকঠিকানা থাকে না ; যেদিন যাতে মেতে উঠি তাই নিয়েই গল্প চলতে থাকে । হাসির গল্প হলে রাখহরি মাতিয়ে রাখে , খুনােখুনি ডিটেকটিভ ধরনের গল্প শুরু হলে পল্লব আমাদের হাঁ করিয়ে রাখতে পারে । আর ভবিষ্যতের মানুষের চেহারা কেমন হবে , তার কোন কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কী ভাবে বদলাবে — এই সব গল্প জুড়লে অনীশ একেবারে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয় আমাদের ।
তা সেদিন বিজন দত্ত হঠাৎ আত্মা আছে কী নেই — তার গল্প জুড়ে দিল । তার হাতে একটা বই ছিল । ইংরেজি বই । তাতে নাকি মরণের পর কোন মানুষের কী গতি হয়েছে তার সম্পর্কে কয়েকটা কাহিনী ছিল ।
আত্মা থেকে প্রেতাত্মার কথা উঠল । আমরা প্রচণ্ড উৎসাহ পেলাম গল্পে , নানারকম হাসি – তামাশা চলতে লাগল ।
এমন সময় ছদ্মবেশী বাবু এসে হাজির । ভদ্রলােকের নাম পরিতােষ । আমরা তাকে ছদ্মবেশীবাবু বলি ! বলি , কেননা ভদ্রলােকের বয়স ষাট হয়ে গেছে , কিন্তু চেহারাটা পঞ্চাশের তলায় ধরে রেখেছেন । চমৎকার স্বাস্থ্য , দেখতেও সুপুরুষ , মানুষটিও চমৎকার । পয়লা নম্বরের গল্পবাজ ।
পরিতােষবাবু আসতেই আমরা তাকে খাতির করে বসিয়ে বললাম , আজকের আসরে আমরা আত্মা , প্রেতাত্মা , ভূত নামিয়েছি । এ সম্পর্কে তিনি কী বলেন ?
একটা কথা বলে নেওয়া দরকার । পরিতােষবাবু বা আমাদের পরিতােষদা নানা ঘাটের জল খাওয়া মানুষ । জীবনে তিনি কত কী করেছেন , কত জায়গা ঘুরেছেন তার ইয়ত্তা নেই । প্রচুর অভিজ্ঞতা । এমন কী , মিলিটারি জীবনেরও ।
পরিতােষদা আমাদের চোখমুখ দেখলেন কয়েক পলক । তারপর বললেন , আত্মা , প্রেতাত্মা , ভূত ! তােমরা তাে দেখছি ক্লাস ওয়ান , ক্লাস টু , ক্লাস থ্রি করে সব সাজিয়ে ফেলেছ ! তা যদি ভূতের কথা শুনতে চাও , আমি কিছু বলতে পারব না । তবে যদি অদ্ভূত কোনও ঘটনার কথা শুনতে চাও তাে একটা কথা বলতে পারি । সেদিনও আমি বুঝি নি , ঘটনাটা কেমন করে ঘটল ; পরে অনেক ভেবেও তার কারণ জানতে পারি নি ; আজও পারি না ।
আমরা বললুম , আপনি সেই ঘটনার কথাই বলুন ।
পরিতােষদা তার চুরুট ধরালেন ধীরে – সুস্থে । তারপর গল্প বলা শুরু করলেন । ঘটনা ঘটেছিল বছর ত্রিশ আগে । আমি তখন ‘ কারবাে গ্রিয়ারস ’ – এর একজন রিপ্রেজেনটিভ । আমাদের কোম্পানি সে সময় বেবি বয়লার আর কোল ফায়াড় বয়লারের কাজ করে । নামী কোম্পানি । তা আমাকে অফিস থেকে এক জায়গায় পাঠাচ্ছিল , নাগপুর থেকে সােয়া দুশাে মাইল হবে । একটা কারখানা চালু হবে । তাদের কোল ফায়ারড বয়লার দরকার । কাগজপত্র , ড্রয়িং আমাদের কাছে যা মজুত আছে তার ক্যাটালগ , দামের ফিরিস্তি ইত্যাদি নিয়ে আমার যাওয়ার কথা । গােছগাছ করে বেরিয়ে যাব , এমন সময় ছােটসাহেব ডেকে পাঠালেন । তার ঘরে গিয়ে দেখা করতেই দু – দশটা কাজের কথার পর হঠাৎ বললেন , মুখার্জি , তুমি যদি পারাে — একটা বাড়তি কাজ সেরে এলে ভাল হয় । বললাম , কী কাজ ? ’ সাহেব বললেন , ‘ তুমি যেখানে যাচ্ছ তার কাছাকাছি হাতারাস বলে একটা জায়গা আছে । লাস্ট ওয়ারের সময় ওখানে ব্রিটিশদের একটা লুকনাে এয়ারবেস ছিল । আমি শুনেছি কেসটায় এখনও অনেক স্ক্র্যাপ পড়ে আছে । ডিসপােজালে সামান্যই বিক্রি হয়েছিল । এখন জায়গাটা জঙ্গল । ওই স্ক্র্যাপ আমরা কিনতে পারি খুবই সস্তায় । তুমি একবার খোঁজ নিয়ে আসবে ।’
আদার ব্যাপারি , জাহাজের খোঁজ নিয়ে কী লাভ ! বললাম , আমি চেষ্টা করব , সার । যদিও বুঝলাম না , প্লেনের স্ক্র্যাপ মেটিরিয়াল আমাদের কোন্ কাজে লাগতে পারে !
তা একদিন , কোম্পানির কাজ সেরে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এক স্টেশনে এসে নামলুম । স্টেশনটা খুব ছােট । আমাদের রােড সাইড স্টেশন যেমন হয় , তেমনই । অবাক ব্যাপার , ওই স্টেশনই আবার জংশন । দেখলাম , ওই স্টেশন থেকে ন্যারােগেজ , মানে ছােট লাইনের গাড়ি ধরতে হবে হাতারাস যাওয়ার জন্য । তােমরা যদি একটু ঘােরাফেরা শুরু করাে , দেখবে — এই রকম জংশন স্টেশন আমাদের দেশে গণ্ডায় গণ্ডায় রয়েছে ।
যে স্টেশনে আমি নেমেছিলুম তার নাম , চিচৌকি । চিচৌকি জংশনে নেমেছিলাম সন্ধ্যে নাগাদ । তখন মে মাস । প্রচণ্ড গরম চলছে । রেলগাড়িতে আমি সেদ্ধ হয়ে গিয়েছি অর্ধেক । গা যত পুড়ছে পুড়ুক , কিন্তু দেখি গরমে এবং স্নানের অভাবে আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে মাঝে – মাঝে । চোখ জবাফুল ।
শুনলাম , ছােট লাইনের গাড়ি ছাড়বে কাল সকালে । তার মানে এই স্টেশনেই আমায় রাত কাটাতে হবে । কাছেপিঠে ওঠার মতন জায়গা তাে নেই-ই , এমনকী একটা ধর্মশালাও নয় ।
স্টেশনে ওয়েটিংরুম বলে কিছু নেই । একটা খুপরি ঘর রয়েছে । সেটাই মুসাফিরখানা । ওই ঘরে একটিমাত্র বেঞ্চি আর পা – ভাঙা এক চেয়ার পড়ে আছে । দেড় হাতের এক কলঘর ! তাতে না আছে জল , না আছে বালতি ।
স্টেশনমাস্টার বললেন , ‘ সামনেই একটা ইঁদারা আছে । জল ভাল । ওখানে গিয়েই স্নান করে নিন । আর ওই দোকানে যান — পুরি , ভাজি পেয়ে যাবেন । ‘ – বলে একটা আটচালা দেখিয়ে দিলেন । আটচালা থেকে গজপঞ্চাশ দূরে একটা টিনের শেড । সেখানে শেডের তলায় খেলনাগাড়ির মত দু – তিনটে কামরা দাঁড়িয়ে । একটা ইঞ্জিন । ছােট বহরের ।
জায়গাটা পাহাড়ি । জঙ্গলে ঘেরা । সারাদিনের তাপ সন্ধ্যের পর থেকেই কমতে শুরু করল ধীরে ধীরে । কুয়ােতলায় গিয়ে স্নান করলাম । জল সত্যিই ভাল । স্নান করে শরীর জুড়েল । তারপর দোকানে গিয়ে পুরি আর আলুর ঘ্যাঁট খেলাম । আর লাড়ু । এক গ্লাস চা ।
একটু রাত হল । স্টেশনের সেই মুসাফিরখানার বাইরে বসে রইলাম চুপ করে । একটা ভাঙা ওজন – যন্ত্র পরে ছিল , তার ওপরে ।
ধীরে ধীরে রাত হয়ে আসতে লাগল । গরমটাও পালাল । তার বদলে জঙ্গলের ঠাণ্ডা বাতাসে আর পাহাড়ি জায়গায় ঠাণ্ডায় ক্রমেই মেন ঘুম পেতে লাগল । নিজের জিনিষপত্র আগলে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
যখন ঘুম ভাঙল , তখন কত রাত আমি খেয়াল করি নি প্রথমটায় । মনে হল , মাঝরাত । এবার বেশ শীত করছিল । বাতাস ঠাণ্ডা । চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার । স্টেশন মাস্টারের ঘরেও কেউ আছে কিনা কে জানে !
আমার ঘুম ভেঙেছিল শব্দ শুনে । মুসাফিরখানার সেই ছােট ঘরে কেমন একটা শব্দ হচ্ছিল । কিসের শব্দ ! আমি যত দূর জানি , ওই ঘরে কেউ নেই , থাকার কথাও নয় । কেননা ওখানে থাকা যায় না । আলাে নেই , পাখা নেই ; একটা জানালা নেই — সেটাও খােলে না । শুধু দরজাটাই যা কোনও রকমে খােলা বন্ধ করা যায় । তাছাড়া ওই ঘরের লাগােয়া দেড় – দুহাতের কলঘরের যা গন্ধ — তাতে কোনও মানুষ কাছাকাছি থাকতে পারে না । তা হলে ?
কান পেতে শব্দটা শুনলাম । কুকুর নয়তাে ? স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একজোড়া কুকুর দেখেছি ঘুরে বেড়াচ্ছিল । প্ল্যাটফর্মটাই তাদের যেন থাকার জায়গা । হতে পারে কুকুর ঢুকে বসে আছে ।
এদিকে আমার শীত -শীত করছিল । শিরশির করা যাকে বলে । মাথাটাও কেমেন ধরা-ধরা লাগল । ট্রেনের ধকল , ওই চামড়া ঝলসানাে গরম , তারপর সন্ধ্যেবেলায় কুয়াের জলে স্নান , এসবের জন্য হতে পারে । তাছাড়া এখন যে রকম ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে বনজঙ্গলের তাতে একটু শীত করতেই পারে । নতুন জলে স্নানের জন্য মাথা ভার হওয়া অসম্ভব নয় ।
মুসাফিরখানার ছােট্ট ঘর থেকে নানারকম শব্দ আসতে লাগল । মনে হল , কে যেন । চেয়ার উলটে ফেলে দিল , বেঞ্চি সরাল , কলঘরে বালতি , মগ টানাটানি করতে লাগল ।
বড় অদ্ভুত ব্যাপার তাে ! কলঘরে বালতি বা মগ কিছুই ছিল না । জলও নয় । তা হলে বালতি , মগ এল কোথা থেকে , আর কেই – বা সেগুলাে টানাটানি করবে ।
শব্দ হতে হতে একসময় সব থেমে গেল । একেবারে চুপচাপ । মনে হল , কোনও কুকুরই ঢুকে পড়েছিল , বেরিয়ে গিয়েছে । কিন্তু কোনদিক দিয়ে গেল ? আমার তাে চোখে পড়ল না ।
ঘুমভাঙা লােকের যেমন হয় , আমার লম্বা – লম্বা হাই উঠছিল । ছলছল করছিল চোখ । একটা সিগারেট ধরালাম ! তখন আমি চুরুটের অভ্যেস করি নি , সিগারেটই খেতাম । হাতের ঘড়ি দেখলাম সাড়ে তিনটে । মানে আর দু ঘণ্টা কাটাতে পারলেই ভাের , গ্রীষ্মের সকাল ।
সিগারেট ধরিয়ে আড়মােড় ভাঙছি , হঠাৎ চোখে পড়ল , সামান্য তফাতে ছােট লাইনের ওপর এক ট্রলি দাঁড়িয়ে । তােমরা নিশ্চয় ট্রলি দেখেছ । রেললাইনের তদারকির কাজে লাগে । বড় লাইনের ট্রলি বড় । ছােট লাইনের ট্রলি এত ছােট যে , বােঝানাে মুশকিল । ধরাে , দুজনে বসার বাসের সিট যতটুকু চওড়া হয় , প্রায় ততটাই ।
ট্রলি দেখছিলাম , চোখে পড়ল এক সাহেব । পরনে হাফপ্যান্ট , গায়ে হাফশার্ট , জুতাে মােজা , মাথায় শােলার টুপি । বড় অবাক লাগল । এই রাত সাড়ে তিনটের সময় মাথায় টুপি পরে কোন্ পাগল ট্রলির কাছে দাঁড়িয়ে আছে ?
আমার কী মনে হল , উঠে পড়ে গজ পঞ্চাশ এগিয়ে গেলাম । গিয়ে দেখি ছােট লাইনের নিচু প্ল্যাটফর্মে ট্রলি আর এক সাহেব দাঁড়িয়ে আছে ।
সাহেব আমাকে দেখল । আমি তাকে ।
মামুলি চেহারা সাহেবের । মাথায় বেঁটে । গলায় রুমাল বাঁধা বলে থুতনি দেখা যাচ্ছিল না । আর টুপির জন্য কপাল ঢাকা পড়েছে ।
আমি কিছু বলার আগেই সাহেব হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল , কোথায় যাব আমি ? . . . আমি বললাম , হাতারাস । গাড়ির জন্য বসে আছি ।
গাড়ি হয়তাে সারাদিনই পাব না । লাইন ভেঙে গিয়েছে সামনে । খবর পেয়ে দেখতে বেরিয়েছে সাহেব । সাহেব নিজেই বলল আবার তুমি যদি আমার সঙ্গে ট্রলিতে আসতে চাও , আমি তােমাকে খানিকটা পৌঁছে দিতে পারব । সেখান থেকে ট্রেকার পাবে হাতরাস যাওয়ার ।
রাজি হব কী হব না করে শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম । ছােট লাইনের গাড়ি যদি না পাই তা হলে তকারণে এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে কী লাভ ! তার চেয়ে এমন কোনও জায়গায় যদি যেতে পারি সেখান থেকে ট্রেকার , টেম্পাে পাওয়া যায় হাতারাস যাওয়ার — আমার পক্ষে তাে সেটাই ভাল ।
সুটকেস আর ছােট হােল্ডঅলটা টেনে এনে ট্রলিতে রাখলাম । সাহেবকে বললাম , ‘ তােমার পাের্টার কই , ট্রলি – কুলি , কারা ট্রলি ঠেলবে ? ‘ . . . সাহেব আমাকে একটা জিনিস দেখাল । ছােট মােটর টুলির একপাশে লাগানো আছে । বুঝলাম , এই ট্রলিটা মােটরে চলে , কুলির দরকার হয় না । আগে কুলিরা ট্রলি ঠেলত , এখন অনেক ভটভটি ট্রলি হয়ে গেছে ইঞ্জিনে চলে ।
সাহেব আর আমি পাশাপাশি বসে । ঠেসাঠেসিকরেই । পায়ের কাছে আমার হােল্ডঅল আর সুটকেস ।
সাহেব স্টার্ট দিল ইঞ্জিনে । ভটভট শব্দ হতে লাগল । ট্রলির মুখের সামনে আলাে ছিল , মােটর গাড়ির লাইটের মতন । তবে একটা মাত্র আলােই জ্বলল দেখলাম । পেছনে একরত্তি লাল আলাে ।
ট্রলি চলতে শুরু করল । আমার হাতঘড়িতে তখন চারটে বাজে । ঘন্টাখানেক এই অন্ধকার থাকবে । তারপর ধীরে ধীরে আঁধার কাটতে শুরু করবে । গরমের দিন । ফরসা হতে হতে বড়জোর সােয়া পাঁচ ।
ট্রলি চলতে শুরু করার পর আমি সাহেবের সঙ্গে গল্প জমাবার চেষ্টা করছিলাম । সাহেব কথাই বলছিল না । দু – চারবার হুঁ – হার পর সাহেব আমাকে লাইনের দিকে দেখিয়ে বলল , কথা বলাে না , আমি এখন লাইন দেখছি ।
রাত্রে যে কেমন করে লাইন দেখা যায় — আমি বুঝলাম না । খানিক পরে মনে হল , চোখের চেয়েও কানটাই যেন আসল । সাহেব লাইনের শব্দ শুনেই যেন অনুমান করার চেষ্টা করছে কোথাও গােলমাল আছে কিনা !
বাধ্য হয়েই আমি চুপ করে থাকলাম । ছােট লাইনের ওপর ট্রলি চলতে লাগল ।
লাইনের শব্দের সঙ্গে মােটরের ফটাফট শব্দ হচ্ছিল ।
ধীরে ধীবে ট্রলি জোর হচ্ছিল শব্দ বাড়ছিল । আশেপাশের জঙ্গলও বুঝি ঘন হয়ে আসছিল , কখনও পাতলা হয়ে যাচ্ছিল । মাঠের পর মাঠ , গাছের পর গাছ , অন্ধকার , কোথাও জোনাকি উড়ছে , কোনও মাঠে আলেয়ার আলাে , কোথাও বা ছােট ছােট পাহাড় ।
শেষরাতে বাতাস বাড়তে লাগল । দেখতে দেখতে ঝড়ের মতন হল । আকাশভরা তারা । হু – হু বাতাসের সঙ্গে শীতও যেন ছুটে আসছিল । আমার কাপুনি লাগছিল ।
সাহেব চুপচাপ । ট্রলির চাকার শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল , যতটা সম্ভব জোরে ট্রলি ছুটছে । চাকাগুলাে যেন লাইনের ওপর থর থর করে কাঁপছে । আর আমাদের চারপাশ থেকে মাঠ , গাছপালা , জঙ্গল , সরু শুকনাে নদী — যা আছে চতুর্দিকে , সবই ছুটে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে ।
আমার ভয় করতে শুরু করেছিল । এ আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সাহেব , বুঝতে পারছিলাম না । অদ্ভুত লােক তাে , মুখে একটাও কথা নেই , সামনে তাকিয়ে বসে আছে , ভয়ডর বলে কিছু কী নেই মানুষটার । সাহেবের বাঁ হাতের দিকে একটা লােহার লম্বা হাতল , মানে লিভার ; ওটাই গাড়ি থামবার যন্ত্র , ব্রেক । আমি সাহেবের ডান পাশে বসে , আমার পক্ষে ওই হাতল ধরা সম্ভব নয় ।
শেষ পর্যন্ত আর আমার সহ্য হল না । ভয়ে চিৎকার করে বললুম , গাড়ি থামান । দয়া করে গাড়ি থামান । এখনই একটা অ্যাকসিডেন্ট হবে । প্লিজ গাড়ি থামান ।
সেই ঝােড়াে বাতাসে আমার গলার স্বর যেন ফুটল না । সাহেবও শুনতে পেল কিনা কে জানে ! ট্রলি বুঝি আরও জোর হল । আর কিছু দেখা যাচ্ছে না । শুধু অন্ধকার , আর রেল লাইনের উপর দিয়ে ট্রলি ছুটে যাওয়ার ভীষণ শব্দ কানে আসছিল ।
পাগলের মতন , কিছু না বুঝেই আমি সাহেবের গায়ের ওপর দিয়ে ব্রেকের হাতলটা ধরতে গেলাম । পারলাম না । তারপর দেখি , সাহেবের মাথার টুপি কখন হাওয়ায় উড়ে গিয়েছে । একমাথা সাদা চুল । অন্ধকারেও সেটা বােঝা যাচ্ছিল । সাহেবের মুখও সাদা । যেন হাড়ের মত সাদা !
ভয়ে – আতঙ্কে চিৎকার করব কি , আমার যেন গলায় স্বর ফুটল না । বুকের মধ্যে কেমন যেন করছিল । মনে হল , আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে । আর ওই অবস্থায় দেখলাম , সাহেবের মাথা , মুখ কিছুই আর নজরে পড়ছে না । গায়ের পােশাকগুলােও যেন কোথায় উড়ে গিয়েছে । মানুষটাই আর নেই । শুধু আমি একলা , তার সেই ছুটন্ত ট্রলি , অন্ধকার মাঠঘাট , জঙ্গল ।
নিজেকে বাঁচাবার জন্য ট্রলির সেই হাতল ধরে প্রাণপণে টানলাম । তখন আমার খেয়াল হয়নি অত জোরে যে – ট্রলি ছুটছে — সেটা থামাতে হলে ধীরে ধীরে থামাতে হবে । ব্রেক ধরানাে চাই আস্তে আস্তে । আচমকা থামাতে গেলেই গাড়ি ছিটকে যাবে , উল্টে — কোথায় গিয়ে পড়বে কেউ জানে না ।
হলও তাই । ট্রলি কোথায় গেল জানি না , আমিও ছিটকে কোথায় পড়লাম কে জানে !
যখন আমার জ্ঞান এল — দেখি হাত , পা , কপালে ব্যাণ্ডেজ জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছি রেলের হাসপাতালে । দিন তিনেক পরে আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল শুনেছি ।
তা মাথাটা সে যাত্রায় বেঁচে গেল। হাত , পা , কোমরে চোট পেয়েছিলাম । আমার বাঁ হাত ভাঙা , ডান পায়ের হাঁটু অকেজো , আর কোমর – পিঠ কোনওরকমে জখমটা সামলে নিয়েছে ।
হ্যাঁ , একটা কথা বলা দরকার । পরে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম , আমার যখন দুর্ঘটনা ঘটে তার ঘণ্টা দুই পরে ছােট লাইনের এক ট্রলি – নিয়ে সাহেব ভােরবেলায় লাইন দেখতে বেরিয়েছিলেন । তিনিই আমাকে পড়ে থাকতে দেখতে পান । নিজেই তুলে আনেন আমাকে । . . . তােমরা হয়তাে জিজ্ঞেস করবে , আগের ট্রলি গেল কোথায় ? সেই প্রথম সাহেবই বা কোথায় গেল ? সত্যি বলতে কী , আমি নিজেই এই ব্যাপার নিয়ে অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি , মাথা ঘামিয়েছি । কোনও সদুত্তর পাইনি । শুধু জানতে পেরেছিলাম — ছােট লাইনে একটা ট্রলি আগে থেকেই দাঁড় করানাে ছিল । সেটাকে আর লাইনে পাওয়া যায়নি ।
ঠিক যে কী হয়েছিল , আমি বলতে পারব না । কেউ আমায় হাতছানি দিয়ে ডেকে ওই ট্রলির ওপর তুলে নিয়েছিল , নাকী আমি বেহুশ হয়ে নিজেই ট্রলিতে গিয়ে বসেছিলাম , জানি না ।
আর যদি বসেও থাকি , ট্রলি চালাতে আমি জানতাম না । কেমন করে সেটা চলল , কে চালাল তার কোনও জবাব আমার জানা নেই । তবে বিশ্বাস করাে , সাহেবের চেহারাটা আমার এখনও খুব আবছা ভাবে মনে পড়ে ।
পরিতােষদার গল্প শেষ হওয়ার পর অনিল বলল , আমি হলে ট্রলি থামাতাম না , দেখতাম সেটা নিজে নিজেই থামে কিনা !
রাখহরি বলল , থামত না । আর থামলেও যেখানে গিয়ে থামত , সেখান থেকে পরিতােষদাকে ফিরিয়ে আনা যেত না ।