সকাল থেকেই আমি মজিদ ভাইকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য খুঁজছি। লোকটির খুব মাছ ধরার নেশা। রাত-দুপুরে এখানে সেখানে মাছ ধরতে যায়। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম ভাই আপনার ভয় করেনা? সে বত্রিশ দাঁত বের করে বললো ভূতের কথা বলছো। আমিতো ভূত চাবাইয়া খাই। কিছুটা দৃষ্টিকটু তার দাঁতের দিকে আমার নজর পরলো দেখলাম দাঁত থেকে রক্ত বের হচ্ছে। কথার মাঝ খানে ওয়াক থু। থুথুর সাথে কিছুটা রক্তও বের হয়েছে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। আমারও আবার মাছ ধরার খুব সখ। তাই মজিদ ভাইয়ের সাথে আমার প্রচুর খাতির।
আজকে তাকে আমার ভীষণ দরকার। একটা জায়গায় তাকে নিয়ে যাবো। সাহসী লোক খুব দরকার। আর সে ছাড়া যে আর কেউ ঐ যায়গায় যাবেনা সেটা আমি নিশ্চিতত। ভাবীকে মজিদ ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো মনে হয় ঐ শশানঘাটে বড়শী দিয়ে মাছ ধরছে। কত না করলাম। কে শুনে কার কথা। কত ঘটনা শুনি। দেখো সাবধান তুমি আবার ঐ পথে যেয়োনা। তোমার ভাই বাড়িতে আসলে তোমার সাথে দেখা করার কথা বলবনে। আমি কিছু না বলে চলে আসলাম।
দ্বি প্রহর। চারদিকে কোন জনমানব নেই। সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে উঠে এসেছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়ে গাল বেয়ে পড়ছে। নদীর পাড় ধরে হেটে চলছি। আমাকে যেতে হবে সামনের শ্যাওড়ার ঝোপ দিয়ে। শ্যাওড়া গাছ খুব ঘন। ফলে সূর্যের আলো এর নিচে ঠিক মত আসেনা। যার ধরুন জায়গাটি সবসময় ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং স্যাঁতস্যাঁতে থাকে। দূর থেকে কেমন জানি একটা ভৌতিক আবহ অনুভব করলাম। শ্যাওড়ার ঝোপের নিচে আসার সাথে সাথেই শরীরে একটা ভাপসা গরম অনুভব করলাম। সাথে সাথেই শরীরে একটা ছমছম অনুভূতি। গভীর জঙ্গলের দিকে তাকালাম। বিধঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারে কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা। আমি হেঁটেই চলছি আমার গন্তব্যে।
সামনে যে বাশেঁর ঝাড়টি দেখা যাচ্ছে দূর থেকে সেটা বড় অদ্ভুধ লাগছে। এই বাঁশঝাড়টি নিয়ে একটি কথা মনে পড়ে গেলো। একদিন এক লোক এমনি এক দ্বিপ্রহরে ঐ বাঁশঝাড়টির নিচ দিয়ে যাচ্ছিলো বরশী দিয়ে মাছ ধরার জন্য। যাওয়ার সময় দেখে একটি বাশ মাটিতে ভেঙ্গে পড়ে আছে। ঐ লোক মনে করলো এতটা না ঘুরে এই বাঁশের উপর দিয়ে চলে যায়। যেই ভাবনা সেই কাজ। বাঁশের কনচি সরিয়ে যখন বাশের উপর দিয়ে পার হতে যাবে ঠিক তখনি বাঁশটি তাকে সহ দাঁড়িয়ে পরলো। তখন ঐ লোকের সেকি চিৎকার। সেইসময় নদী দিয়ে যাচ্ছিলো একটি নৌকা। তারা এসে তাকে গাছ থেকে নামালো। নামানোর সাথে সাথেই লোকটি অজ্ঞান হয়ে গেলো এবং লোকটির সারা শরীর নীল হয়ে গেলো। সুস্থ হওয়ার পর যা বললো তা ছিলো এই রকম যে বাশের উপরে উঠে দেখে কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে তাকে দেখে নাচছে। তাদের ইয়া বড় বড় দাঁত আর দাঁত থেকে রক্ত পরছে, আর জ্বিহবাটা ছিলো খুব কালো। আল্লাহ তাকে নিজ হাতে বাঁচাইয়া দিছে।
জেলে পাড়ার নতুন বউ সেদিন এখানে একটি ভাঙ্গা বাঁশ দেখে গরুটি বাশেঁ বেধেঁ গেলো এবং ভাবলো ঘাসও খেতে পারবে আবার বাশেঁর কচিপাতাও খেতে পারবে। কিন্তু যখন গরুটিকে বিকেল বেলা পানি ও ভাতের ফেন খাওয়াতে গেলো তখন গরুটিকে না দেখে এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ দুইটি বাঁশের বাতাসে ঘর্ষনের ফলে অদ্ভুদ শব্দ শুনা গেলো। কিছুটা মাংসের হাড় চাবিয়ে খাওয়ার মতো শব্দ। শব্দটি শুনে যখন উপরে তাকালো তখনি সেই বউয়ের চিৎকার। তার চিৎকার শুনে যখন জেলে পাড়ার লোকেরা দৌড়াইয়া আসলো, ততক্ষণে এই মহিলাটি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পরে রইলো। কেউ কিছুই না বুঝে যখন এদিক সেদিক তাকিয়ে ঘটনাটি বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো তখনি সেই বাঁশের বাতাসে অদ্ভুদ শব্দটি ভেসে আসলো। সবাই উপরে তাকিয়ে চোখের পলকে একসাথে জড়ো হয়ে গেলো। কারও মুখ দিয়ে এতটুকুও শব্দ বের হলোনা। শুধু মাত্র মহিলাটির অজ্ঞান দেহটি বয়ে নিয়ে তারাতারি চলে আসলো। গ্রামের সবাই চিৎকার তাদের চিৎকার শুনে জেলে পাড়ায় জড়ো হলো। সবার মুখে এক কথা ঘটনা কি? বায়োজষ্ট জেলে লবাদাদু সবাইকে নিয়ে বাঁশঝাড়ের দিকে রওনা হলো। অতি উৎসাহী কয়েকজন আগে আগে দৌড়ে গেলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই অতি উৎসাহীরা পিছনে দৌড়াতে লাগলো আর বোবাদের মতো চিৎকার করতে লাগলো।
সবাইতো অবাক। কি হয়েছে? কি হয়েছে? তারা কোন কিছু বলতেই পারলোনা। শেষে সবাই মিলে ঐ জায়গায় গেলো। উপরে তাকিয়ে দেখলো গরুটি একটি বাঁশে ঝুলে আছে। সারা শরীর থেকে খাবলা দিয়ে মাংস নিয়ে যাওয়ার দাগ স্পষ্ট। শেষে অতি উৎসাহী ও লবাদার কাছ থেকে যা শুনা গেলো তা হলো এইরকম। ওরাও দেখলো গরুটি গাছে ঝুলে আছে, কিন্তু সেই সাথে দেখলো চার-পাচটি ছোট ছোট বাচ্চা ঐ গরুটির উপর ঝুলে আছে। আর হাতের বড় বড় নখ দিয়ে সেই গরুর মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। কি ভীবৎস সে দৃশ্য।
সেই থেকে এই পথে আর কেউ খুব একটা আসেনা। নিতান্তই যদি কারো আসতে হয় তবে সাথে সাহসী কাউকে নিয়েই আসে। আমি চলছি আমার গন্তব্যে। আমি বাঁশঝাড়ের খুব কাছে চলে আসলাম। কিছুটা ভয় ভয় লাগছে। বাশঝারের কাছে এসে আমার চক্ষুছানাভরা। আমিতো অবাক। এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলাম। আগের ঘটনাগুলো খুব মনে পড়ছে। একটা বাঁশ ভেঙ্গে রাস্তার উপর পরে আছে। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর সোজা বাঁশটিকে পাশ কাটিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাতাসে বাঁশে বাঁশে ঘর্ষণের সেই ভিবৎস শব্দটি শুনা যাচ্ছে। আমি উপরে তাকালাম না। বুঝতে পারছিলাম আমাকেও একই ভাবে ভয় দেখানো হবে তাই কোন ভাবেই উপরে তাকাবনা। কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা। রাক্ষসের শিকার মিস হইয়া গেলে যে বিভৎস শব্দ করে কিছুটা সেই রকম। আমি যত দূরে সরে যাচ্ছি ততটা শব্দের ক্ষিপ্ততা বেড়েই চলছে।
সামনে নদীর একটা বাঁক দেখা যাচ্ছে। এই বাঁকটার পরই শশানঘাট। যদিও এটা অনেক আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সেটাও একটা বিরাট ঘটনা। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পোড়া কাঠ, ছেঁড়া কাথা, কিছু চুল পরে আছে। দূরে একটা গাছে একটা বালিশ ঝুলছে। আমি ভূত খেকো মজিদকে খুঁজছি। ঐ তো নদীর পাড়টার একটু নিচে মাথা দেখা যাচ্ছে। আমি সামনে এগোলাম। দেখলাম লোকটা একমনে হাতে বড়শী নিয়ে বসে আছে শিকারের আশায়। আমি উনাকে চমকে দেওয়ার জন্য শব্ধহীন আগাচ্ছি। একদম কাছে গিয়ে বললাম মজিদ ভাই, কোন সাড়া নাই। আমি আবার বললাম ভূত খেকো মজিদ ভাই। এইবার উনি পিছনে তাকালেন এবং সাথে সাথেই চিৎকার………….।