প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা কাকে বলে ? বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা লিখুন ।
উত্তর :– অনিয়ন্ত্রিত এবং নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাঝামাঝি পর্যায়ে এক শিক্ষাব্যবস্থা যা অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মতো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয় , আবার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মতো বাঁধাধরা নিয়মে আবদ্ধও নয় । এই শিক্ষাই হল প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা বা নিয়মবহির্ভূত শিক্ষা ( Non – formal education ) ।
প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
( 1 ) প্রাসঙ্গিকতা : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার কর্মসূচি প্রয়োজনভিত্তিক এবং সকল বয়সের শিক্ষার্থীদের চাহিদার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয় ।
( 2 ) নমনীয়তা : নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার কড়াকড়ি প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় একেবারেই নেই । এই শিক্ষাব্যবস্থা সময় , স্থান , ব্যাপ্তি , হাজিরা , পাঠ্যসূচি , পদ্ধ এবং মূল্যায়ন প্রভৃতি দিক থেকে অত্যন্ত নমনীয় ।
( 3 ) ব্যাবহারিকতা : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক উভয় ক্ষেত্রের পাঠদান বা কর্মসূচি গ্রহণের ব্যবস্থা থাকে ।
( 4 ) বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পুনরায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় বিদ্যালয়ছুট শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় । আর্থিক বা অন্যান্য কারণে যেসব ছেলেমেয়ে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় অংশ নিতে পারে না বা পড়া শুরু করেও মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় , সেইসব ছেলেমেয়েরা এই শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা পুনরায় শিক্ষার মূলস্রোতে ফিরে আসার সুযোগ পায় ।
( 5 ) নির্দিষ্ট সময়সীমার অনুপস্থিতি : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় সময়সীমা নির্দিষ্ট থাকে না শিক্ষার্থী নিজের কাজের ফাঁকে যে – কোনো সময়ে পড়াশোনা করতে পারে । বাঁধাধরা নিয়মে প্রতিদিন কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয় না ।
( 6 ) নির্দিষ্ট বয়সসীমার অনুপস্থিতি : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকে না । যে – কোনো বয়সের শিক্ষার্থী এতে অংশ নিতে পারে । এই জাতীয় শিক্ষায় কোনো শ্রেণিতে ভরতি হওয়ার ক্ষেত্রেও বছরে একবারের পরিবর্তে দুবার বা তারও বেশিবার সুযোগ পাওয়া যায় ।
( 7 ) নির্দিষ্ট শিক্ষালয়ের মধ্যে আবদ্ধ নয় : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার পঠনপাঠন চারদেওয়ালে ঘেরা কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয় না । সাধারণত ডাকযোগে শিখন বিষয়গুলি ( study materials ) শিক্ষার্থীর বাড়িতে পাঠানো হয় । শিক্ষার্থী নিজের বাড়িতেই সেগুলির সাহায্যে পড়াশোনা করে ।
( 8 ) কমখরচের শিক্ষা : প্রথাগত শিক্ষার তুলনায় প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার খরচ অনেক কম এই শিক্ষার খরচ এমনভাবে স্থির করা হয় যাতে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাও এতে অংশ নিতে পারে।
( 9 ) পাঠক্রম নির্বাচনের স্বাধীনতা : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় সব শিক্ষার্থীর জন্য এক ধরনের পাঠক্রম , শিক্ষাপদ্ধতি এবং পরীক্ষাপদ্ধতির ব্যবস্থা নেই । এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পাঠক্রম থাকে । শিক্ষার্থীরা নিজের চাহিদা ও পছন্দ অনুয়ায়ী আলাদা আলাদা পাঠক্রম নির্বাচন করতে পারে ।
( 10 ) মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নমনীয় : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মতো কঠোর নয় । একসঙ্গে সব পত্রের পরীক্ষায় না বসলেও চলে । যে – কটি পত্রে শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি ভালো হয়েছে বলে মনে হয় , সে সেই কটি পত্রেই পরীক্ষায় বসতে পারে । ধীরে ধীরে সবকটি পত্রে পাস নম্বর পেলে সে এক সময় ওই কোর্সে উত্তীর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয় ।
( 11 ) জীবনব্যাপী জ্ঞানলাভ : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় যেহেতু শিক্ষার্থীর বয়সজনিত কোনো বাধা নেই শিক্ষার্থী তাই সারাজীবন ধরে পড়াশোনা করতে পারে এবং এই শিক্ষার মধ্যে দিয়ে সারাজীবন ধরে নতুন নতুন তথ্য ও জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায় ।
(12 ) নির্দেশভিত্তিক শিক্ষা : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার স্টাডি মেটিরিয়াল বিশেষভাবে প্রস্তুত করে শিক্ষার্থীর কাছে পাঠানো হয় । শিক্ষার্থীরা সেইসব নির্দেশ অনুযায়ী পড়াশোনা করলে সঠিকপথে চালিত হতে পারে ।
( 13 ) সাহায্যকারী শিক্ষাব্যবস্থা : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল কোনো কারণে কোনো শিক্ষার্থী প্রথাগত শিক্ষাগ্রহণে অপারগ হলে , এই শিক্ষাপদ্ধতি তাদের শিক্ষাগ্রহণে সাহায্য করে ।
( 14 ) শিক্ষকের ভূমিকা : প্রথাগত শিক্ষার মতো প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা দেন না । এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী সুন্দর ও সাবলীলভাবে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যপুস্তিকা বা মডিউল প্রস্তুত করেন । শিক্ষার্থী নিজেই সেই পুস্তিকা পাঠ করে প্রয়োজনীয় বিষয় শিখে নিতে পারে ।
প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা : শিক্ষার সার্বিক প্রসারে এবং শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণের দিক থেকে নিয়মবহির্ভূত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না ঠিকই , তবে এই শিক্ষাব্যবস্থাতেও বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায় । ত্রুটিগুলি হল—
( 1 ) সবধরনের চাহিদাপূরণে ব্যর্থতা : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা শিক্ষার্থীর দৈহিক , মানসিক , সামাজিক , প্রাক্ষোভিক , নৈতিক প্রভৃতি সবকটি চাহিদা পূরণ করতে পারে না । শিক্ষালয়ে প্রতিদিন না আসার কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয় । কারণ শুধু বই পড়ে ওই সব চাহিদা পুরণ হয় না ।
( 2 ) সামাজিক বিকাশের সুযোগের অভাব : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় এককভাবে কোনো সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে না । শিক্ষার্থীরা যেহেতু দলগতভাবে শিক্ষালাভের সুযোগ পায় না , তাই শিক্ষার্থীদের সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয় ।
( 3 ) অনির্দিষ্ট পাঠক্রম ও শিক্ষাপ্রক্রিয়া : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় পাঠক্রম অনির্দিষ্ট এবং শিক্ষণ পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় এই প্রকার শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীর যথাযথ বিকাশের পক্ষে সহায়ক হয় না ।
( 4 ) পেশাকেন্দ্রিক শিক্ষা : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় শিক্ষার্থীকে দ্রুত জীবিকা অর্জনের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয় । এই কারণে এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীর কাছে পেশাকেন্দ্রিক এবং উৎপাদননির্ভর হয়ে পড়ে । এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভার যথাযথ বিকাশ সম্ভব হয় না ।
(5 ) সহযোগিতার অভাব : প্রথাবহির্ভূত শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে নিয়মিত শ্রেণিশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না । ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার বোধ গড়ে ওঠে না ।
(6 ) শংসাপত্রের গ্রহণযোগ্যতা কম : অনেক ক্ষেত্রেই প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার দ্বারা অর্জিত শংসাপত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না । প্রথাগত শিক্ষার দ্বারা অর্জিত শংসাপত্রের গুরুত্ব অধিকাংশ সময়েই প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার দ্বারা অর্জিত শংসাপত্রের তুলনায় বেশি ।