” ছেলেটির আদি বাড়ি ছিল বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামে । সেখানে ছেলেটি পড়া । শুরু করে । পরে তার বাবা চন্দননগরে একটা বাড়ি কিনে বসবাস করতে থাকলে ছেলেটি চন্দননগরে ডুল্পে কলেজে ( বর্তমান নাম কানাইলাল বিদ্যামন্দির ) পড়তে থাকে । ছাত্র হিসেবে সে ছিল মেধাবী । পড়াশুনায় ছিল নিষ্ঠা । একদিন ক্লাশে ইতিহাসের শিক্ষকের পড়ানাে শুনে সে প্রতিবাদ করে ওঠে । শিক্ষকমশায় বলেছিলেন , ‘ মাত্র চোদ্দজন ঘােড়সওয়ার এসে গৌড়রাজের রাজধানী অধিকার করে নেয় । ছেলেটি তখনই প্রতিবাদ করল , ‘ এ তথ্য মিথ্যা । একটি সুরক্ষিত রাজধানী ও রাজপ্রাসাদ কখনই চোদ্দজন ঘােড়সওয়ারের পক্ষে অধিকার করা সম্ভব নয় । এর জন্য ছেলেটিকে কিন্তু শাস্তি পেতে হয়েছিল ।
এরপর ছেলেটি কলকাতায় মর্টন কলেজে ভর্তি হল । এখানে পড়াশুনা করাকালীন এক কাণ্ড করে বসল । বাঙালীদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হত না । সে যুদ্ধ বিদ্যা শিখবে বলে অবাঙালি পরিচয় দিয়ে ভর্তি হতে গেল । তার ইচ্ছা , শিবাজীর মতাে সৈন্যদল গঠন করে ইংরাজদের সঙ্গে যুক্ত করবে । কেননা , পরাধীন জাতির স্বাধীনতা ব্যতিরেকে অপর কোনাে ধর্ম থাকতে পারে না , স্বামী বিবেকানন্দের এই বাণী তাকে উদ্বদ্ধ করেছিল । যা হােক , ছেলেটি সৈন্যবিভাগে ভর্তি হতে সক্ষম হয়নি , তার অবাঙালি পরিচয় ধরা পড়ে যায় ।
ছেলেটির বাবা সিমলায় কাজ করতেন । সেখানে তিনি ছেলেকে নিয়ে যান । ছেলেটি আর পড়তে রাজি না হতে , তাকে সরকারী প্রেসে কপি হােন্ডারের কাজে ঢুকিয়ে দেন । সে সময় কিছু সরকারী গােপন নথিপত্র প্রেসে ছাপা হচ্ছিল । ছেলেটি সেই গােপন তথ্য একটা ইংরাজি সংবাদপত্রের দপ্তরে পাঠিয়ে দেয় । তা প্রকাশিত হতে সরকার মহলে হৈ চৈ শুরু হল । বাবা বুঝলেন , এ তার ছেলেরই কীর্তি । তাই তিনি তাকে ছাড়িয়ে আনলেন সে কাজ থেকে । তবে ছেলেটি নিজের চেষ্টায় দেরাদুনের বনবিভাগে একটি সরকারী চাকরি জোগাড় করে নিয়েছিল ।
এখন তার জেগে উঠল বিপ্লবী সত্তা । ছেলেটি উত্তরভারতে বিপ্লবী সংগঠন করার কাজে নিজেকে যুক্ত করে পূর্ণ উদ্যমে নেমে পড়ল । মহাবিপ্লবী বাঘা যতীন সে সময় বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন । তারই পরামর্শে উত্তরভারতে ছেলেটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তােলার দায়িত্ব প্রাপ্ত হল । এ সময় তার সঙ্গে অনেক বিপ্লবী নেতার পরিচয় হয় । তারাও ছেলেটির নির্দেশ মতাে কাজ করতে রাজি হয়ে তাকে নেতৃত্ব পদে স্বীকার করে নিল ।
ছেলেটির বয়স তখন ২৬ বছর । সে বছর ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হচ্ছে । ১৯১২ খ্রিঃ ২৫ শে ডিসেম্বর চঁদনিচকের রাস্তা ধরে বিরাট শােভাযাত্রা করে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লীতে প্রবেশ করবেন । ছেলেটি পরিকল্পনা করে ফেলল । লর্ড হাডিঞ্জকে বােমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে ভারতে তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে । ছেলেটির বিশ্বস্ত কর্মী বসন্ত বিশ্বাস চাদনিচকে মেয়েদের দলের মধ্যে মিশে থেকে বােমা ছুঁড়ল । লর্ড হার্ডিঞ্জ বােমার আঘাতে আহত হল । আর তারা ভিড়ের মধ্যে অনায়াসে গা – ঢাকা দিল । গা – ঢাকা দিল বটে , তবে রেহাই নেই । গােয়েন্দাদের অনুসন্ধানের ফলে জানা গেল , এই বােমা বিস্ফোরণের মাথা দেরাদুনের বনবিভাগের কর্মচারী সেই ছেলেটি ।
এরপর পুলিশ তৎপর হয়ে উঠল । সারা দেশে ছেলেটির নামে পােস্টার ছড়িয়ে দেওয়া হল । ঘােষনা করা হল , যে সেই ছেলেটিকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারবে । তাকে ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে । কিন্তু ছেলেটিকে ধরা সহজ নয় । সে নিপুণ ছদ্মবেশের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে জনতার মধ্যে ঘুরে বেড়াত । ইংরাজি , বাংলা ছাড়াও হিন্দি , মারাঠি , গুজরাটি , উর্দু প্রভৃতি ভাষায় চোস্ত কথা বলতে পারত । তাকে ধরা অত সহজ ছিল না ।
কে সেই ছেলেটি ? ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবের কাজে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছিল । ছেলেটি নাম রাসবিহারী বসু । তার জন্ম ১৯৮৬ খ্রিঃ ২৫ শে মে । পিতার নাম
বিনােদবিহারী বসু । পিতামহ কালীচরণ বসু একজন বিখ্যাত লাঠিয়াল । তারই তত্ত্বাবধানে রাসবিহারী সুগঠিত ব্যায়ামপুষ্ট দেহের অধিকারী ছিলেন ।
ছদ্মবেশ ধারণে দক্ষ ছিলেন রাসবিহারী । একবার গােপন সূত্রে তার আসার খবর পেয়ে পুলিশ বেলেঘাটার এক ঘাটি ঘিরে ফেলল । পুলিশের জাল থেকে একটা মাছও পর্যন্ত পালাবার উপায় নেই । অথচ পুলিশ রাসবিহারীকে খুঁজে পেল না । অনেকের চোখে পড়েছে , রাস্তার পাশে এক বাড়ির বারান্দায় এক অ্যাংলাে ইন্ডিয়ান শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধ বেহালাবাদক বেহালা বাজিয়ে চলেছে । সে যে রাসবিহারী , তা কেউ ভাবতে পারল না ।
এরপর আন্ডার গ্রাউন্ডে থেকে তিনি বিপ্লবী কর্মসূচী চালিয়ে যেতে লাগলেন । রাসবিহারীর গতিবিধি আশঙ্কাজনক হওয়ায় তার সহযােগী বন্ধুরা দেশ ত্যাগ করে জার্মানি বা অন্য কোনাে স্বাধীন দেশে যাবার পরামর্শ দিলেন । সে সময় রবীন্দ্রনাথ জাপানে যাচ্ছেন শুনে , রাসবিহারী ঠাকুর – পরিবারের সহযােগিতায় রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারী হিসাবে পাসপাের্টের ব্যবস্থা করে ‘ শকি মারু ’ নামে একটি জাপানি জাহাজে যাত্রী হলেন এবং পুলিশের চোখে ধুলাে দিয়ে জাপানে পৌঁছে গেলেন ।
রাসবিহারী জাপানে কোবে বন্দরে নেমে চিনের নেতা সান – ইয়াৎ সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন । মিলিত হলেন ভারতের নির্বাসিত নেতা লালা লাজপৎ রায় প্রমুখের সঙ্গে । তিনি জাপান থেকেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন । আর বহু পিস্তল ও টোটা ভারতের বিপ্লবীদের জন্য পাঠাতে লাগলেন ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে গেছে । ১৯৪১ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে জাপান মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছে । রাসবিহারী ‘ আজাদ হিন্দ সঘ ’ নামে একটি সৈন্যবাহিনী গঠন করে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিলেন । ইতিপূর্বে সুভাষচন্দ্র বসু গােপনে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে মস্কো হয়ে বার্লিনে । তিনিও অস্থায়ী ভাবে স্বাধীন ভারত সরকারের সূচনা করছিলেন । তিনিও দেড় হাজার সৈন্য নিয়ে ‘ আজাদ হিন্দ বাহিনী ’ পত্তন করেছেন । ১৯৪৩ খ্রিঃ ২ রা জুলাই সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে হাজির হলে , ৪ তারিখে রাসবিহারী তার হাতে তার আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব অর্পণ করেন ।
রাসবিহারী জাপানের এক মন্ত্রীকন্যা তােসিকোকে বিবাহ করেছিলেন এবং জাপানের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন । এই মহাবিপ্লবী ১৯৪৫ খ্রিঃ টোকিওতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
❤ ‘ Rashbehari Bose could dress up himself either as a Punjabi or as an old Maharastrian in such a perfect manner that it was impossible to suspect him as one in desguise . ‘
–পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট
”