প্রবাদ – প্রবচন ও বাগধারা

🛑 প্রবাদ – প্রবচন ও বাগধারা 🛑


প্রবাদ – প্রবচনের উৎস জাতির মর্মলােক । চেষ্টাকৃতভাবে এগুলির জন্ম নয় । যুগ যুগ ধরে দৈনন্দিন জীবনধারার মধ্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অধিকাংশ প্রবাদ – প্রবচনের উৎপত্তি । কিছু এসেছে কবি – সাহিত্যিকদের রচনার অংশ থেকে । ক্ষেত্রবিশেষে লােককথা ও লােকগাথা থেকে ভালােলাগা কিছু কিছু টুকরাে কথা এসেছে প্রবাদ – প্রবচন হয়ে । ভাষায় এভাবে প্রবাদ – প্রবচনের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ও হচ্ছে ।

প্রবাদ – প্রবচনের সংজ্ঞা সম্পর্কে বলা হয় দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বাক্যরূপ হল প্রবাদ বা প্রবচন । প্রবাদ – প্রবচনকে ইংরেজিতে বলা হয় “ Proverb ।

প্রবাদ – প্রবচনের উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল :

🛑এক : প্রবাদ – প্রবচন চেষ্টাকৃত সৃষ্টি নয় , স্বতঃস্ফুর্ত মৌখিক উক্তি ।

🛑দুই : প্রবাদ – প্রবচন বাক্যের অংশ নয় , প্রধানত সম্পূর্ণ বাক্য ।

🛑তিন : প্রবাদ – প্রবচন আক্ষরিক অর্থকে পিছনে ফেলে লক্ষ্যার্থে বা ব্যঙ্গার্থে তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে ।

🛑চার : জাতির অন্তর্লোক হল প্রবাদ – প্রবচনের সূতিকাগার । জাতির ও সমাজ সংসারের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান , ভাব ও চিন্তার প্রকাশ হল প্রবাদ – প্রবচন ।

প্রবাদ – প্রবচন ভাষার বিশিষ্ট সম্পদ । প্রবাদ – প্রবচনের প্রয়ােগে ভাষা ক্ষেত্রবিশেষে তীক্ষ ক্ষুরধার হয় , ক্ষেত্রবিশেষে রসমণ্ডিত হয় । ক্ষেত্রবিশেষ ভাষাকে আলংকারিক অর্থতাৎপর্যও দেয় ।


⭐♨️ কয়েকটি প্রচলিত প্রবাদ – প্রবচন ♨️⭐

🍀১. অতি চালাকির গলায় দড়ি ( অতিরিক্ত চালাকি করতে গেলে দুঃখজনক পরিণাম ঘটে ) —ভেবেছিল উইল নকল করে মামার নিষ্পত্তিটা হস্তগত করবে , ধরা পড়ে জেল হল – তাই কথায় বলে ‘ অতি চালাকির গলায় দড়ি ‘ ।

🍀২. অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ ( প্রকৃত মতলব গােপন করবার উদ্দেশ্যে ভক্তির আতিশয্য প্রকাশ ) —ঘরে ঢুকতেই প্রণামের ঘটা দেখে বুঝলাম কিছু টাকাকড়ি ঝাড়বার ধান্দায় আছে , যাকে বলে ‘ অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ ‘ ।

🍀৩. অনভ্যাসের ফোঁটা কপাল চড়চড় করে : ( অনভ্যাস অস্বস্তির কারণ হয় ) —ছেলেবেলা থেকে খালি পায়ে হাঁটলে , বন্ধু – বান্ধবের চাপে পড়ে হঠাৎ জুতাে পায়ে চড়ালে । হাঁটতে পারবে কেন , ভুললে তাে চলবে না ‘ অনভ্যাসের ফোটা কপাল চড়চড় করে ‘।

🍀৪. আপনি ভালাে তাে জগৎ ভালাে ( নিজের মন ভালাে হলে সকলকেই ভালাে বলে বােধ হয় ) —তিনি ‘ আপনি ভালাে তাে জগৎ ভালাে ’ নীতিতে বিশ্বাসী বলে সংসারে সবাই তাঁর মিত্র , শত্র বলতে কেউ নেই ।

🍀৫. উঠন্তি মুলাে পত্তনে চেনা যায় ( প্রথম অবস্থা দেখে পরিণামে কী হতে পারে বােঝা যায় ) —ছেলেবেলায় ঠাকুর নিয়ে যেভাবে মাতামাতি করত তা দেখে বুঝেছিলাম পরে ও সাধু – সন্ন্যাসী হবে , তাই হয়েছে , প্রকৃতপক্ষে ‘ উঠন্তি মুলাে পত্তনে চেনা যায় ‘।

🍀৬. এক হাতে তালি বাজে না ( দুপক্ষেরই যােগ না থাকলে দ্বন্দ্ব – কলহ হয় না ) —তুমি একপক্ষ চুপচাপ থাকলে অথচ ঝগড়াঝাঁটি হল , বিশ্বাস করতে পারছি না , কারণ সবাই জানে ‘ এক হাতে তালি বাজে না ‘ ।

🍀৭. কারও পৌষমাস কারও সর্বনাশ ( ব্যক্তিবিশেষে একই ঘটনা সুখকর কিংবা দুঃখকর হয় ) —রেল দুর্ঘটনার পর দেখলাম কেউ মরছে যন্ত্রণায় ছটপটিয়ে আর কেউ বা লুটে – পুটে নিয়ে থলি ভরছে , সত্যি ‘ কারও পৌষমাস কারও সর্বনাশ ‘ ।

🍀৮. গাঁয়ে মানে না , আপনি মােড়ল ( অন্যে মানে না , অথচ নিজেকে বড়াে মনে করা ) — ‘ গাঁয়ে মানে না , আপনি মােড়ল ’ যারা , কেউ না চাইলেও তাদের সব কাজে হামবড়া ভাব দেখানাে স্বভাব ।

🍀৯. গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল ( পাওয়ার আগে ভােগের ইচ্ছা ) —চাকরি পাওয়ার আগেই গাড়ি – বাড়ির যেভাবে হিসেব করছ , তা দেখে তােমার ‘ গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল ’ – এর অবস্থা বলে মনে হচ্ছে ।

🍀১০. গেঁয়াে যােগী ভিখ পায় না ( পরিচিত গুণী ব্যক্তি সমাদর পায় না ) —অনিমেষবাবু মস্ত বড়াে কবি , তােমাদের অঞ্চলেই থাকেন , অথচ তােমরা চেনাে না , হবেই তাে , ‘ কথায় বলে গেঁয়াে যােগী ভিখ পায় না ‘ ।

🍀১১ . ঘরপােড়া গােরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায় ( বিগত বিপদের কথা স্মরণ করে সামান্য বিপদের ভয়ে কাতর ) – বজ্রপাতে হালের গােরুটা মারা যাওয়ার পর থেকে মেঘ দেখলেই পরান মাজি আর মাঠে গােরু রাখে না , ওর অবস্থা এখন ‘ ঘরপােড়া গােরু , সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায় ‘ ।

🍀১২. ঘুঁটে পােড়ে গােবর হাসে ( যে দুর্দশা সকলের হতে পারে তা দেখে আনন্দ প্রকাশ ) –পিতৃশ্রাদ্ধে শ্রীনিবাসকে মুণ্ডিতমস্তক হতে হয়েছে দেখে ছোঁড়ারা হেসে খুন , ওরা জানে না ‘ ঘুটে পােড়ে গােবর হাসে ‘ ।

🍀১৩. চোরে চোরে মাসতুতাে ভাই ( অসৎ মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব ) —দুই তিন গায়ের চোরেদের মধ্যে গলায় গলায় ভাব দেখলে বােঝা যায় ‘ চোরে চোরে মাসতুতাে ভাই ‘ কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য ।

🍀১৪. চোরের ওপর বাটপাড়ি ( চোরকে ঠকানাে ) —রাতের অন্ধকারে রায় বাড়ির হাজার দুই টাকার কাঠ সরিয়ে রেখে ফেলারাম নিশ্চিত ছিল , কিন্তু তা পরের রাতেই হাপিস হতে দেখে সে বুঝেছে ‘ চোরের উপর বাটপাড়ি ‘ হয়েছে ।

🍀১৫. ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি ( প্রাণান্তকর অবস্থা দেখে পরিত্রাণের প্রয়াস ) —দরকার নেই বাপু ক্লাবের কর্মকর্তা হয়ে , সেবার দু – মাসেই ইন্দ্রনীলের ‘ ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা ’ – পদত্যাগ করে প্রাণে বাঁচে ।

🍀১৬. জলে কুমির ডাঙায় বাঘ ( উভয় সংকট ) —তার অবস্থা হয়েছে ‘ জলে কুমির ডাঙায় বাঘ ’ – বড়ােবাবুর মন রাখতে গেলে ছােটোবাবু চটেন , আর ছােটোবাবুর পক্ষ নিলে বড়ােবাবু চাকরি খাওয়ার ভয় দেখান ।

🍀১৭. ঢাল নেই তলােয়ার নেই নিধিরাম সর্দার ( কাজ করার মতাে উপযুক্ত উপকরণ যার নেই ) —দরজা – জানালার কাজ করবে বলে এসেছে , কিন্তু তােমার হাতিয়ার কোথায় , দেখে মনে হচ্ছে ‘ ঢাল নেই তলােয়ার নেই নিধিরাম সর্দার ‘ ।

🍀১৮ . ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে ( সব জায়গায় সমান দায়িত্ব পালন করা ) —অফিসে অতবড়াে চাকরি করলেও সুজাতাকে দু – বেলা হাঁড়ি ঠেলতেই হয় – ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান না ভেঙে পরিত্রাণ নেই’ ।

🍀১৯. দশের লাঠি একের বােঝা ( দশজনের কাজ একজনের পক্ষে গুরুভার তুল্য ) — বিশজনের সংসারে কর্তাবাবুর একা খাটতে হলে পারবেন কেন , ওঁর তাে নাভিশ্বাস উঠবেই , তাই তাে কথায় বলে— ‘ দশের লাঠি একের বােঝা’ ।

🍀২০. ধরি মাছ না ছুঁই পানি ( বিনা আয়াসে কাজ সফল করা ) —সংসারে ‘ ধরি মাছ না ছুঁই পানি ‘ নীতির লােকেরা সবসময়ে পরের মাথায় কাঠাল ভেঙে খায় , নিজের গায়ে আঁচড়টি লাগতে দেয় না ।

🍀২১. নুন আনতে পানতা ফুরায় ( খুব অভাব অনটনে দিন যাপন ) — ‘ নুন আনতে পানতা ফুরায় ’ যাদের , তাদের পঞ্চাশ ব্যঞ্জন খাবার দিবাস্বপ্ন না দেখাই ভালাে ।

🍀২২. পেটে খেলে পিঠে সয় (লাভের সম্ভাবনা থাকলে পরিশ্রম করা যায় ) —’পেটে খেলে পিঠে সয় ‘ বলেই টাকা পেলে মানুষ দুর্যোগ ঘাড়ে করেও দৌড়ােয় ।

🍀২৩. বরের ঘরের পিসি কনের ঘরের মাসি ( উভয় পক্ষে ) —যারা চোরকে বলে চুরি । করতে , গৃহস্থকে বলে সজাগ থাকতে , তাদের চিনে রেখাে , তারা ‘ বরের ঘরের পিসি কনের ঘরের মাসি ‘ ।

🍀২৪. বেল পাকলে কাকের কী ? ( অনধিকারীর অর্থহীন আপনােশ ) —সরকারি কর্মচারীদের ভাতা বাড়লে আমাদের মতাে খেত – মজুরদের কিছু যায় আসে না , ‘ বেল পাকলে কাকের কী ‘ ?

🍀২৫. ভাগের মা গঙ্গা পায় না ( ভাগের কাজে আন্তরিকতা না থাকলে সে কাজ পণ্ড হয় ) —মরণকালে গঙ্গাযাত্রায় বাসনা ছিল বুড়ির , কিন্তু ছ – ছেলে থাকা সত্ত্বেও বুড়ির গঙ্গাযাত্রা দুরের কথা , অন্তর্কলহের জন্য ছেলেদের হাতের মুখাগ্নিও হল না , একেই বলে ‘ ভাগের মা গঙ্গা পায় না ‘।

🍀২৬. মরা হাতি লাখ টাকা ( গুণী মানুষ দুরবস্থায় পড়লেও তার গৌরব থাকে অক্ষুন্ন ) — রমেনবাবু এখন গরিব হলেও নিজে না খেয়ে অভাবী ভিখিরিকে অন্নদানের আগেকার স্বভাব ঠিক আছে , ‘ মরা হাতি লাখ টাকা ‘ দাম তাে যাওয়ার নয় ।

🍀২৭. যার ধন তার ধন নয় নেপােয় মারে দই ( প্রকৃত অধিকারীকে বঞ্চিত করে অন্য লােকে ধন ভােগ করা ) —নিঃসন্তান কাকার সারা জীবনের সঞ্চিত সম্পদ অথর্ব কাকাকে সরিয়ে দিয়ে সবই হস্তগত করেছে ভাইপাে , এ যেন ‘ যার ধন তার ধন নয় নেপােয় মারে দই’ ।

🍀২৮. লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন ( অপরের টাকা যথেচ্ছ খরচ করা ) —মতিলাল বন্ধুবান্ধব নিয়ে দু – হাতে টাকা উড়াতে লাগল , সে জানে কাকার মােটা টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স আছে ‘ লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন ‘ ।

🍀২৯. সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে ( সেয়ানা লােকের ইশারা সেয়ানা লােকে বােঝে ) — লােকটার চোখের চাউনি দেখেই সেয়ানা কাকা বুঝেছে অর্থের প্রতি তার গভীর লালসা , আসলে ‘ সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে ‘ ।

🍀৩০. হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী ( মুখ লােকের মুখ উপদেষ্টা ) —যেমন হয়েছে প্রধান , তেমনি হয়েছে তার পরামর্শদাতা উপপ্রধান , এদের দেখে কার না মনে হবে ‘ হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী’।