নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বা প্রথাগত শিক্ষা কাকে বলে ? বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা লিখুন ।
উত্তর :– নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষা : সমাজ দ্বারা নির্ধারিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনভাবে এবং উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট পাঠক্রম অনুসারে শিক্ষার্থীদের যে বিশেষ শিক্ষাদান করা হয় , তাকে প্রথাবদ্ধ বা বিধিবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষা বলে । শিক্ষাবিদ জে পি নায়েক – এর মতে , সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার মধ্যে যে শিক্ষা পরিচালিত হয় তাকে প্রথাগত শিক্ষা বলে ।
নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য : বিধিবদ্ধ শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে , সমাজ তার নিজের প্রয়োজনে বিদ্যালয় স্থাপন করে । বহু বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত রূপ পেয়েছে । বর্তমান কালে ি বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
( 1 ) নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী পরিকল্পিত : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা পরিকল্পিত হয় নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ভিত্তিতে । দর্শন , মনোবিদ্যা , সামাজিক প্রত্যাশা প্রভৃতিকে ভিত্তি করে এক্ষেত্রে শিক্ষার লক্ষ্য স্থির করা হয়ে থাকে ।
( 2 ) নির্দিষ্ট সূচি দ্বারা সীমাবদ্ধ : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট সূচি থাকে । কয়েকটি নিয়মনীতির উপর ভিত্তি করে এই শিক্ষা প্রদান করা হয় । সুপরিকল্পিত নির্দেশের মাধ্যমে এই ধরনের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চালিত হয় ।
( 3 ) নির্দিষ্ট পাঠক্রম নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট এবং সুপরিকল্পিত পাঠক্রম থাকে । ব্যক্তির চাহিদা ও সমাজের প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে ওই পাঠক্রম নির্ধারণ করা হয় ।
( 4 ) যোগ্য শিক্ষক দ্বারা প্রদত্ত : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল , এই শিক্ষা যোগ্য এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হয় ।
( 5 ) কঠোর শৃঙ্খলা : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় কঠোর শৃঙ্খলা দেখা যায় । শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়কেই এই শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয় । শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিলে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ।
( 6 ) নির্দিষ্ট বয়সের শিক্ষার্থী : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বয়স আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা থাকে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় , শিক্ষার্থীদের 3+ বছর বয়সে প্রাকৃপ্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং 6+ বছর বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভরতি করা হয় ।
( 7 ) নির্দিষ্ট স্থান : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী প্রত্যেককেই একটি নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হতে হয় । শিক্ষার স্তর অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক বিদ্যালয় , মাধ্যমিক বিদ্যালয় , উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় , মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয় । শিক্ষকরাও সেইসব স্থানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের কাজ করেন ।
( 8 ) নিয়মিত উপস্থিতি : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় ছুটির দিনগুলি ছাড়া প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীকে শিক্ষালয়ে উপস্থিত হতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শিক্ষালয়ে থাকতে হয় ।
( 9 ) শিক্ষক – শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক পরস্পর মুখোমুখি আলোচনায় অংশ নেয় । শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীকে পড়ান , শিক্ষার্থীরাও তেমনই শিক্ষককে প্রশ্ন করে । এই মিথস্ক্রিয়ার ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
( 10 ) নিয়মিত পরীক্ষা : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষার্থী পাঠ্য বিষয়গুলির উপর কতখানি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেছে তা জানার জন্য নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয় ।
( 11 ) রাষ্ট্রের ভূমিকা : অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় আর্থিক দায়দায়িত্ব এবং পরিচালনার ভার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে । দেশের শিক্ষাপরিকল্পনা , পাঠক্রম তৈরি , নীতিনির্ধারণ , পরিচালনব্যবস্থা সবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হয় ।
নিয়ন্ত্রিত বা প্রথাগত শিক্ষার ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা : একটি নির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামোর মধে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার বিশেষ সুবিধা থাকলেও এর সীমাবদ্ধতাও কম নয় । সেইস সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটিগুলি হল—
( 1 ) যান্ত্রিক ও কৃত্রিম পদ্ধতি : এটি একটি যান্ত্রিক এবং কৃত্রিম শিক্ষাপদ্ধতি । কঠো নিয়মশৃঙ্খলার জালে আটক থাকায় এক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যান্ত্রিকভাবে শিক্ষালে আসে , নির্দিষ্ট সূচি মেনে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ করে । চার দেওয়ালে ঘেরা এ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই হাঁপিয়ে ওঠে ।
( 2 ) সুযোগসুবিধার অভাব : স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে একদিকে প্রবল হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি , অন্যদিকে শিক্ষা বিষয়ে জনগণের বেড়ে চলা চাহিদা — এই দুটির মধ্যে সামঞ্জস্য আনা যায়নি , ফলে সুযোগসুবিধার অভাব রয়েছে ।
( 3 ) শিক্ষকনির্ভরতা : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা মূলত শিক্ষকনির্ভর প্রক্রিয়া । নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য সক্ষম ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব দেখা যায় ।
( 4 ) বৈচিত্র্যহীনতা : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার পাঠক্রমে বৈচিত্র্যের অভাব লক্ষণীয় ।
(5)অপরিবর্তনশীলতা : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় পাঠক্রম পূর্বনির্দিষ্ট হয় বলে যখন – তখন প্রয়োজনমাফিক তাতে রদবদল করা যায় না । তাই দরকারমতো বিভিন্ন বিষয়ের উপর সাম্প্রতিকতম তথ্য সবসময় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না । ফলে এই শিক্ষা থেকে সর্বাধুনিক তথ্য লাভ করার ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে যায় ।
( 6 ) নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়কেই একটি নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষালয়ে উপস্থিত হতে হয় । বিভিন্ন কারণে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ওই নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষালয়ে হাজির হতে পারে না । ফলে তারা পিছিয়ে পড়ে ।
( 7 ) পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা মূলত পরীক্ষাকেন্দ্রিক ।
( 8 ) শিক্ষক – শিক্ষার্থী সম্পর্কের অবনতি : বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষায় শিক্ষক – শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক পাঠক্রমের চাপে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর উপর জোর করে পাঠক্রমের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় । শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও সামর্থ্যকে বিবেচনা করা হয় না ।
( 9 ) সীমিত প্রবেশপথ : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার ক্ষেত্রে যে – কোনো স্তরে মাত্র একটিই প্রবেশপথ থাকে । শিক্ষার্থী যদি সময়মতো ওই নির্দিষ্ট পথে কোনো শ্রেণিতে ভরতি হতে না পারে , তাহলে সেই শিক্ষাবর্ষে তার শিক্ষার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় । মন্তব্য : নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বেশকিছু ত্রুটি থাকলেও এই শিক্ষাব্যবস্থাটি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রধান স্থান অধিকার করে আছে । সরকার বা রাষ্ট্র যেহেতু এই শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে , তাই এই শিক্ষার উপাদানগুলি জনসাধারণের উপযোগী করে এবং সবদিক বিবেচনা করে প্রস্তুত করার চেষ্টা করা হয় । তাই বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও অনিয়ন্ত্রিত ও প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার তুলনায় এই নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার উপরেই অধিকাংশ মানুষ বেশি আস্থা রাখেন ।